ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাসীদের ভোটাধিকারের চেয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান বেশি জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২০ এপ্রিল ২০১৮

প্রবাসীদের ভোটাধিকারের চেয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান বেশি জরুরী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়াও। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের আগে আরও বেশি আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করছেন এই মুহূর্তে ভোটাধিকারের চেয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান জরুরী। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার কারণে ব্যাংক একাউন্ট খোলা এবং জমিজমা বিক্রিসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। তারা মনে করছেন প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান যতটা সহজ, ততটাই চ্যালেঞ্জিং ভোটাধিকার প্রয়োগ। তাদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের আগে ভোটদানের প্রক্রিয়া কি হবে বা কোন পদ্ধতিতে ভোট প্রদান করবে তা নিয়ে আরও বেশি করে আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া বিদেশে যারা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে অবস্থান করছেন তাদের ভোটাধিকার না রাখার কথাও আলোচনায় উঠে এসেছে। তবে বিশিষ্টজনরা বলেন, প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কাজ অনেকটাই সহজ। বিশেষ করে শ্রমিকসহ বিভিন্নভাবে দেশের বাইরে প্রবাসী হিসেবে যারা অবস্থান করছেন তাদের প্রত্যেকের এমআরপি বা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট রয়েছে। যা যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এসব প্রবাসীদের ভোটার করার ক্ষেত্রে বা জাতীয় পরিচয় প্রদানের জন্য নতুন করে তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। এমআরপির ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজ করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘প্রবাসী বাংলাদেশীদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটাধিকার প্রয়োগ’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে অংশ নিয়ে বর্তমান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক ও বিশিষ্টজনরা প্রবাসীদের বিষয়ে এসব সুপারিশমালা তুলে ধরেন। সেমিনারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, কমিশনের অন্য চার কমিশনার, কমিশনের সাবেক সদস্য, বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ভোটাধিকার বিষয়ে এই সেমিনারে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে তারা দ্বৈত নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র না দেয়া এবং ভোটাধিকার না রাখার সুপারিশ করে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে আমেরিকায় যিনি একবার নাগরিকত্ব নিয়েছেন সেদেশের আইন অনুযায়ী অন্য দেশের পক্ষে নাগরিক হিসেবে তার আনুগত্য প্রকাশের সুযোগ নেই। তাই উচিত হবে দ্বৈত নাগরিকদের ভোটাধিকার না রাখা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের ভোটার করতে দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রধান সমস্যা। সেমিনারের উদ্বোধনকালে বলেন, বর্তমানে প্রক্সি ভোট ও পোস্টাল ভোটের নিয়ম আছে। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারেন। আগামী নির্বাচনের আগে এসব পদ্ধতি নিয়ে প্রচার করা হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান মাহবুব হাসান সালেহ বলেন, আইনে দ্বৈত নাগরিকদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই তাদের ভোটাধিকারের দরকার নেই। তিনি আমেরিকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে যারা আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদের শপথের সময় থেকেই তারা আর অন্য কোন দেশের নাগরিক হতে পারেন না। একবার যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক হলে আইনে অন্য দেশের প্রতি নাগরিক হিসেবে আনুগত্য প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে এই দ্বৈত নাগরিকের সংখ্যা বাদ দিলে প্রবাসীর পরিমাণ অতি নগণ্য। তিনি সুপারিশ করে বলেন, ইউরোপ আমেরিকায় এখনই এই কার্যক্রম হাতে নেয়ার দরকার নেই। আলোচনায় অংশ নিয়ে ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান শিকদার বলেন, ‘প্রবাসী ও অভিবাসী (দ্বৈত নাগরিক) এক বিষয় নয়। ভোটাধিকার প্রবাসীরা পেতে পারেন। কারণ, তারা অন্য দেশের নাগরিক নন। তবে অভিবাসীরা দেশ ছাড়েন অন্য দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তারা যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন সেখানকার ভোটাধিকারসহ সব সুবিধাই ভোগ করেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হিসেবে যারা রয়েছেন তাদের এমআরপিতে আইডির বিষয় রয়েছে। এটি মাথায় রেখেই যদি জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজ শুরু করা যায় তাহলে বিষয়টি সহজ হবে। তিনি বলেন, এমআরপি যাদের আছে তাদের নির্দ্বিধায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সেই নাগরিকের তথ্য যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন পড়বে না। সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহও এমআরপির ওপর ভিত্তি করে প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দানের বিষয়টি সমর্থন করে বলেন, সৌদি আরবে বর্তমানে ২১ লাখ প্রবাসী রয়েছেন। প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রস্তুত। তিনি বলেন, আমরা লাখ লাখ বাংলাদেশীকে ইতোমধ্যে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট দিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আমরা সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশীদের নির্বাচন কমিশনের সময় অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে পারব। মালয়েশিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম অভিমত প্রকাশ করে বলেন, যারা প্রবাসী হিসেবে দেশের বাইরে যাবেন তাদের আগে থেকেই ভোটার লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। দেশের বাইরে যাওয়ার আগে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। ফলে বিদেশে এই বিষয়টি নিয়ে আর ঝামেলায় পড়তে হবে না। তবে তিনি প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে উল্লেখ করেন। সেমিনারে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানও বলেন, যারা পাসপোর্ট নিয়ে দেশের বাইরে কাজের জন্য যান বয়স অনুযায়ী তারা ভোটার হওয়ার যোগ্য। কারণ ১৮ বছরের নিচে কেউ কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে পারে না। পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র দুটো একসঙ্গে করলে সহজ হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, বিদেশে যারা প্রবাসী হিসেবে জীবনযাপন করছেন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন রয়েছে। এটি না থাকায় আইনেও এখন সাধারণ নাগরিকদের জীবন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটা নিশ্চিত সব কিছুতেই সম্মান রয়েছে। কিন্তু ভোটাধিকার প্রদানে জাতীয় পরিচয়পত্রে কোন গুরুত্ব নেই। এটার প্রয়োজন নেই। তবে তিনি এমআরপির ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়টি সমর্থন করে বলেন, যখনই প্রবাসীদের এমআরপি দেয়া হয়েছে তখনই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের অধীনে আনা যেত। সহজ বিষয়টি আগে জরুরী। তিনি বলেন, দেশের বাইরে ঠিক কি পরিমাণ প্রবাসী বসবাস করছে তার সঠিক কোন সংখ্যা নেই। সরকারের এক দফতর আলাদা পরিসংখ্যার তুলে ধরছে। তিনি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ওপর জোর দিয়ে বলেন, দেশের কোন কোন সংসদীয় আসনে ১০ থেকে ৫০ হাজার প্রবাসী রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে দেখা গেছে মাত্র ২ হাজার ভোটের ব্যবধানে কোন প্রার্থী জয়লাভ করছে। প্রবাসীদের বিশাল একটি অংশ ভোটাধিকার ধেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা ভোট দিতে পারলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারতো। তিনি বলেন, প্রবাসীদের জন্য ব্যাংক করতে পারলেও এখনে ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। অথচ এটা মোটের কঠিন কোন কাজ নয়। সেমিনারে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারপার্সন জি এম কাদের বলেন, দ্বৈত নাগরিকদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে পাবলিক অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করতে দেয়া উচিত নয়। যারা পাবলিক অফিসের দায়িত্ব সামলাবেন তাদের শুধু বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘এর আগে দুই-একজন দ্বৈত নাগরিক মন্ত্রী হয়েছেন। এই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে দেখা উচিত। সেমিনারের শুরুতে প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। এতে তিনি উল্লেখ করেন প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে জনবল ও যন্ত্রপাতি সঙ্কট এবং বৈধ নাগরিক নিশ্চিতকরণ। সুপারিশমালায় তিনি বলেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে কাজটি শুরু করতে পারি। প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, বিদেশে প্রচুর বাংলাদেশী অবস্থান করছে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সহিংসতা থামানো ও বিপুল অর্থব্যয় অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
×