ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দোলনকারীদের সড়ক অবরোধ ॥ রাজধানীতে যানজট, ভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১১ এপ্রিল ২০১৮

আন্দোলনকারীদের সড়ক অবরোধ ॥ রাজধানীতে যানজট, ভোগান্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মতিঝিল থেকে শাহবাগমুখী আসা বাসগুলোকে দৈনিক বাংলা মোড় থেকেই ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছিল। তারপর পরিবহনের রূপ পাল্টে যায়। নয়া পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, মৌচাক হয়ে বাংলামোটর বা ফার্মগেট। অর্থাৎ দৈনিক বাংলা থেকে বাংলামোটর সড়কে কোন ঘোষণা ছাড়াই যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল মঙ্গলবার দুপুরের আগে থেকেই। এতে সড়কে যানবাহনের চাপ যেমন বাড়ে, তেমনি যানজট আর ভোগান্তির সীমা ছিল না। বিকেল পর্যন্ত যানজটের মাত্রা সীমা ছাড়ায়। হঠাৎ করেই নগরীতে অসনীয় যানজটের পরিস্থিতি কেন? স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে। কেনই বা সড়ক পরিবর্তন করে যানবাহন চলতে হচ্ছে। উত্তর খুঁজে পাওয়া গেল কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেছে। আর যানজটসহ ভোগান্তি মাত্রা ছাড়িয়েছে এ কারণেই। এটা নতুন কিছু নয়। রবিবার রাত থেকেই প্রতিদিন ইচ্ছেমতো সড়কে আন্দোলন করায় নগরবাসীকে এই দুর্ভোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে নগর বিশেষজ্ঞসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বারবারই বলে আসছেন, যে কোন দাবিতে আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকারের অংশ। কিন্তু কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই সড়ক অবরোধ ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি আইনের চোখে যেমন অপরাধÑ তেমনি সামাজিক-মানবিক দিক বিবেচনায় সঙ্গত নয়। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে কোন ইস্যুতে সড়ক অবরোধের ঘটনা হরহামেশাই হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন হয় না। হলেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে আন্দোলনকারীদের ইচ্ছেমতো চলে এসব কর্মসূচী। ফলে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তেমনি জরুরী প্রয়োজনে রোগী পরিবহনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এতে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার কথাও বলছেন তারা। সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বছর সারাদেশে সাড়ে ছয় হাজার দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা ১১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনেও অন্যতম কারণ হিসেবে যানজট। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, অনেক সময় যানজটের কারণে দ্রুত হাসপাতালে না নিতে পারার কারণেও অনেকে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। সোমবার আন্দোলকারীদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে সরকারের আশ্বাসে এক মাসের জন্য আন্দোলন স্থগিত করা হয়। কিন্তু একটি পক্ষ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। সোমবার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। মঙ্গলবার সকালের পর থেকে ফের বিচ্ছিন্নভাবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ফলে নগরীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। চরমে ওঠে নাগরিক দুর্ভোগ। কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর কুড়িল-বিশ্বরোড, বসুন্ধরা গেট, নর্দ্দা-প্রগতি সরণির সামনে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অবরোধ বিকেলে স্থগিত করা হয়। এরপর বিকেল ৫টায় যান চলাচলের জন্য রাস্তা খুলে দেয়া হয়। বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার আশরাফুল করিম বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের অবরোধ আজকের মতো তুলে নিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুুর ১২টা থেকে এই এলাকা অবরোধ করে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কোটা সংস্কারের আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। এ আন্দোলনে যোগ দেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অবরোধের মুখে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়ে। দুপুর ১২টার দিকে প্রথমে বসুন্ধরা গেট সংলগ্ন রাস্তা অবরোধ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে আশপাশের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা রাস্তার দুই দিকেই আড়াআড়িভাবে দুটি বাস রেখে যান চলাচল বন্ধ রাখেন। সেই সঙ্গে রাস্তার ওপর অবস্থান নেন কয়েকশ’ শিক্ষার্থী। তারা কোটা সংস্কার চেয়ে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দেন। বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রগতি সরণি দিয়ে যান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। সড়কের দু’পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট বক্তব্য না আসা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আন্দোলনকারীদের ॥ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে কোটা সংস্কারের বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজুভাস্কর্যে এ ঘোষণা দেন আন্দোলনের সমন্বয়ক রাশেদ খান। তিনি বলেন, কোটা সংস্কারে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রীর কাছ থেকে বিভ্রান্তমূলক বক্তব্য শুনে আসছি। আমরা আর বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে চাই না। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার কাছ থেকে সরাসরি ঘোষণা চাই। আমরা আশা করি জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সন্তানদের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেবেন। আমরা আর কোন মন্ত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা আশা করি না। আমরা সরাসরি আমাদের জননেত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা চাই। সন্ধ্যায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। পাঁচ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করার পরে শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন। এ সময় তারা জাতীয় সংসদে দেয়া কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোাগান দিতে থাকেন। রাত ৮টার দিকে তারা কৃষিমন্ত্রীর কুশপুতুলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ‘বাজেটের আগে কোটা সংস্কার সম্ভব নয়’ অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়। একইসঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে তাদের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। পরে আন্দোলন স্থগিত করার আগে তারা বুধবার সকাল ১০টা থেকে ফের আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনে আহতদের দেখতে ঢামেকে ঢাবি উপাচার্য ॥ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত আহত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তিনি হাসপাতালে যান। এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী, সিন্ডিকেট সদস্য নীলিমা আকতার, সহকারী প্রক্টর মোঃ আবদুর রহীম, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। উপাচার্য হাসপাতালে গিয়ে ১০১, ১০২ এবং ১০৩ নং ওয়ার্ডে যান এবং আহতদের খোঁজখবর নেন। এ সময় তিনি আহতদের পাশে আছেন উল্লেখ করে যেকোন প্রয়োজনে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আহতদের খোঁজখবর নিয়েছি। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আছেন। তারা জানিয়েছেন, চিকিৎসার বিষয়ে ডাক্তাররা আন্তরিক। এরপরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের চিকিৎসার বিষয়টি বিশেষভাবে দেখতে বলেছি। এছাড়া আহতদের নিবিড়ভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করতে বলেছি। ওয়েবসাইট হ্যাক করে কোটা সংস্কারের দাবি ॥ বিডিনিউজ জানায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে মঙ্গলবার রাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছে। রাত ১২টার দিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে চেষ্টা করে ঢোকা যায়নি। গুগলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট সার্চ করলে এই ওয়েবসাইটটি হ্যাক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়। ফেসবুকে একজন বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতরের ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার ভিডিও তুলেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি ওই সময়টাতে ওয়েবসাইটটিতে ছিলেন। রাত সোয়া ১১টার পরপরই এই হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি ঘটে। হ্যাকাররা ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করার পর স্ক্রিনে ‘হ্যাকড বাই বাংলাদেশ’ লেখা ঝুলিয়ে দেয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের দাবিও ছিল তাদের লেখায়। রাত ১২টার পর এসব ওয়েবসাইটে ঢুকে হ্যাকিংয়ের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে ওয়েবসাইটগুলো খুলছিল না। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়া চলছে।
×