ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের পরিমাণ ;###;না বাড়ায় ব্যাংকে ডলারের সঙ্কট তীব্র হয়েছে

নিয়ন্ত্রণহীন ডলার ॥ বেড়েই চলেছে দাম

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ এপ্রিল ২০১৮

নিয়ন্ত্রণহীন ডলার ॥ বেড়েই চলেছে দাম

রহিম শেখ ॥ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে ডলারের দাম। গত বছরের শুরুতে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০.৬৬ টাকা। বৃহস্পতিবার এই ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৫.২৫ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে ডলারপ্রতি দাম বেড়েছে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা। এদিকে গত আট মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে রফতানি আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। মূলত আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের পরিমাণ না বাড়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট তীব্র হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, সে পরিমাণ রফতানি আয় ও রেমিটেন্স দেশে আসেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে খোলা এলসিগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। ফলে সামনের দিনগুলোতে ডলারের দাম আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, গত জুন থেকেই দেশে ডলারের বাজারে সঙ্কট চলছে। এ থেকে উত্তরণে প্রতিদিনই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে সীমিত পরিসরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে প্রায় দেড় শ’ কোটি ডলার। তার পরও শান্ত হচ্ছে না ডলারের বাজার। টাকার বিপরীতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৭৯ টাকা ৩০ পয়সা। এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতি ডলার কিনতে ব্যয় হচ্ছে ৮২ টাকা ৯৪ পয়সা। সে হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই এক বছরের ব্যবধানে ডলারপ্রতি দাম বেড়েছে ৩ টাকা ৬৪ পয়সা। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে আরও বেশি দামে। সোমবার বেসরকারী এনসিসি ব্যাংকের ঘোষিত মূল্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিল ৮২ টাকা ৫০ পয়সা ও বিক্রয়মূল্য ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা। এনসিসি ব্যাংকের ঘোষিত মূল্যের মতোই ডলারের মূল্য ঘোষণা করেছে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। কোন কোন ব্যাংক আবার ঘোষিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। আমদানি পর্যায়ে প্রতি ডলার ৮৫.২৫ টাকায় বিক্রি করছে কেউ কেউ। যদিও ৮৩ টাকার বেশি দামে ডলার বিক্রি না করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। ডলারের বাজারের এ অস্থিরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কৌশল নির্ধারণে সম্প্রতি বৈঠকও করেছে সংগঠনটি। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বাফেদা চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ডলারের বিদ্যমান সঙ্কট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সব ব্যাংকের এমডিরই বক্তব্য ছিল, ডলারের বাজারের বিদ্যমান সঙ্কট অস্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার না ছাড়ায় ব্যাংকগুলোর সঙ্কট বাড়ছে। সঙ্কট উত্তরণের বিষয়ে বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্তও হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাজারের পরিস্থিতি ও ব্যাংকগুলোর সঙ্কট নিয়ে বাফেদার পক্ষ থেকে একটি লিখিত প্রস্তাবনা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের সঙ্গে বৈঠক করা। এছাড়া রফতানি আয় বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ এবং রেমিটেন্স বাড়াতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তও হয় বৈঠকে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি অর্থবছরে যে পরিমাণ আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, সে পরিমাণ ডলার আমাদের হাতে নেই। এজন্য প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে, সেটি চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। বাফেদার বৈঠকে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৯৮৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। ফলে এলসি খোলায় নিষ্পত্তি বেড়েছে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। এই অবস্থায় গত আট মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে রফতানি আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের পরিমাণ না বাড়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট তীব্র হয়েছে। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, সে পরিমাণ রফতানি আয় ও রেমিটেন্স দেশে আসেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে খোলা এলসিগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। ফলে বাজারে ডলার সঙ্কট আরও তীব্র হবে। তিনি বলেন, বিদ্যমান সঙ্কট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আমাদের পাশে চাচ্ছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার আলোকে বাজারে ডলার ছাড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। অন্যথায় বিদ্যমান সঙ্কট আরও তীব্র হয়ে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। ডলারের সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাজারে বিক্রি করা ডলারের সিংহভাগই কিনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক। মূলত বড় বড় সরকারী প্রকল্পের মূলধন যন্ত্রপাতি ও খাদ্যপণ্য আমদানিতেই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংকের অর্থায়ন বেড়েছে। এতে প্রতিমাসেই আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকে সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। একই সময়ে বাজার থেকে কোন ডলার কেনার প্রয়োজন হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। অথচ গত অর্থবছর বাজারে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার বিক্রির দরকার হয়নি। যদিও ওই অর্থবছর বাজার থেকে ৪১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগের কয়েক অর্থবছরেও দাম পড়ে যাওয়া ঠেকাতে বাজার থেকে অতিরিক্ত ডলার কিনে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে অনেক খরচ হচ্ছে। গত বছর বন্যায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্য আমদানি অনেক গুণ বেড়েছে। তা ছাড়া দেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগেও কিছুটা গতি এসেছে; কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় না বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে এর দরকে একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলছে। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, ডলারের এই দাম বৃদ্ধি আমদানি ব্যয় এবং ভোক্তা ব্যয় বাড়াচ্ছে। ডলারের বেশি দামের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।
×