ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৫ মার্চ ২০১৮

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী

ফিরোজ মান্না, কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ রোহিঙ্গাদের শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে সেনা সদস্যদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে বাসস্থান ও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতায় সেনা সদস্যরা দিন-রাত কাজ করছে। শুরুতে বেসামরিক প্রশাসন রোহিঙ্গাদের নিয়ে চরম হিমশিমে পড়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, তারা তখন সামাল দিতে পারছিলেন না। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে চলে যাচ্ছিল উখিয়া ও বালুখালিসহ নানা এলাকায় ঠাঁই নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সেনা সদস্যরা বিভিন্ন কাজে সরকারের বিভিন্ন দফতরকে সহযোগিতা দিচ্ছে। এমন কি দেশী-বিদেশী নানা সংস্থাকেও সহযোগিতা দিচ্ছে। গত দুই দিন উখিয়া ও বালুখালীর বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর হামলা চালায়। ওই হামলার পর এক রাতের মধ্যে ৩০ গ্রামের মানুষ জীবন নিয়ে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। এক দিনেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা দেয়ার কাজটি করে ডিসি অফিস। আইন-শৃঙ্খলার পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পরে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে যায় তখন আর বেসামরিক সংস্থাগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল। পরে সরকারের সিদ্ধান্তে সেনা সদস্যরা কাজ শুরুর পর শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মাত্র চারদিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে সেনা সদস্যরা। সেনা সদস্যদের এমন কার্যক্রমে দেশী-বিদেশী এনজিওগুলোও সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে। তাদের কার্যক্রমে কেউ কোন বাধা দেয়ার সাহস পাচ্ছে না। আশঙ্কা ছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার। কিন্তু ওই ধরনের অপরাধ এখন পর্যন্ত হয়নি। দু’একটা ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই তারা বসবাস করছে। সেনা উপস্থিতির কারণে কেউ কোন কিছু করার আগে চিন্তা করছে। সেনা সদস্যদের উপস্থিতির জন্যই বিপন্ন রোহিঙ্গাদের কেউ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। জঙ্গী তৎপরতা তেমন নেই। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেকেই বলেছেন, সেনা সদস্যরা না থাকলে এখানে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হবে। জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে অনেকেই। বাইরে থেকে বিভিন্ন গ্রুপ ওঁৎ পেতে আছে রোহিঙ্গাদের কি কি কাজে ব্যবহার করবে। বিশেষ করে জঙ্গী কার্যক্রমে তাদের ব্যবহার করতে পারে এমন খবর গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সেনাবাহিনী কাজ শুরু করে ২৩ সেপ্টেম্বর। ২২ সেপ্টেম্বর ১০ পদাতিক ডিবিশনের কর্মকর্তারা নিজেদের কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে সভা করে। সেনাবাহিনী কাজ শুরু করে প্রথমে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে মানুষকে মানুষের প্রকৃত সম্মান নিশ্চিত করা, প্রধান সড়ক যত দ্রুতসম্ভব খালি করা, শরণার্থীদের এক জায়গায় জড়ো করা, সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করা। সেনাবাহিনী কাজ শুরুর আগে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ছিল ১২, সেনাবাহিনী সেটা ছাব্বিশে নিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর ইসিবি ১৯ কিলোমিটার সমান্তরাল সড়ক তৈরি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে রেশন কার্ডও তৈরি করে তারা। তারাই উখিয়া ডিগ্রী কলেজে সমন্বয় কেন্দ্র করে সব এনজিও, আইএনজিও এবং সরকারী সংস্থার সমন্বয়ের জন্য এবং সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে একটি সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। শিবিরের শরণার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী কোন জিনিসটা তাদের কাছে আগে পৌঁছানো দরকার সাপ্তাহিক সভায় আলোচনা করে ঠিক করা হয়। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কটি ছিল মানুষ আর যানবাহনে প্রায় পরিত্যক্ত। সেনাবাহিনী নিযুক্ত হওয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে সড়ক স্বাভাবিক হয়ে যায়। সব সংস্থার প্রতিটি ত্রাণের গাড়ির সঙ্গে সেনাবাহিনীর একজন প্রতিনিধি দেয়া হয় যাতে সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণ হয়। শুরুর দিকে এমনও হয়েছে প্রতিদিন ৫শ’ মেট্রিক টনের বেশি ত্রাণ এসেছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে। এই ত্রাণ সামগ্রী একটা জায়গায় মজুদ করা হয়। পরে যেসব এলাকায় ত্রাণ আগে দরকার সেসব এলাকায় সেনা সদস্যদের হাপারায় ত্রাণ পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেই সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীই রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শরণার্থীদের মধ্য থেকেই নেতৃত্বদানে সক্ষমদের ‘মাঝি’ নির্বাচন করে। মাঝিদের অধীনে বেশকিছু পরিবারের ত্রাণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়। এসব মাঝিদের নেতৃত্বদানে রয়েছে আবার প্রধান মাঝি। মাঝিরাই রাত আটটার পর শিবিরজুড়ে টহল দেয় যাতে কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- না ঘটে। আর এসব কিছুই করা হয়েছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে। রোহিঙ্গা নিবন্ধনে প্রায় একক ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনী। ২৫ সেপ্টেম্বর তারা শুরু করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়া। যেটা পরে তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতির অধীনে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে, কেউ যাতে নকল কিংবা জাল আইডি করতে না পারে সেজন্য গ্রহণ করেছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রোহিঙ্গা শিবিরে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে সেনা সদস্যরা। তাদের ১০ এর অধিক টিম কাজ করেছে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে। ওষুধ বিতরণের ক্ষেত্রেও সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে একত্রিত করেছে সেনাবাহিনী। গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীদের স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের জন্য তারা নিজ উদ্যোগে নানা সংস্থার সহায়তায় স্থাপন করেছে ‘প্রসব কক্ষ’। সুষ্ঠু স্যানিটেশনের জন্য সেনা সদস্যরা এক মাসের মধ্যে নির্মাণ করেছে ১০ হাজার টয়লেট। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাথে কাজ করেছে সেনা সদস্যরা। এক্ষেত্রে, তারা কর্মরত বিদেশী সংস্থাদের শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠক্রম বিষয়ে সার্বক্ষণিক নিদের্শনা দিয়েছে ও সহায়তা প্রদান করেছে। পাঠক্রমে যাতে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মুখের ভাষা প্রাধান্য পায় সে বিষয়েও নজর রাখছে তারা। সেনা সদস্যরা দক্ষ হাতে সামাল দিয়েছে এমন একটা ভয়াবহ সঙ্কট। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সারাবিশ্বের সুনাম অর্জন করেছে আর এবার সে অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে তারা অত্যন্ত সফলভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সামাল দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঁচটি মৌলিক অধিকারÑ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাÑ নিশ্চিত করতেই কাজ শুরু করে সেনা সদস্যরা আর সময়ের ব্যবধানে যেটা তারা করেছে একাগ্রতার সঙ্গে। সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে শরণার্থীদের মনেও তারা আস্থার জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। সীমান্তের ওপারে আর এপারে সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। এক প্রান্তে সেনা সদস্যরা মানুষকে হত্যা নির্যাতন ধর্ষণ করে আর অন্য প্রান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথম প্রথম রোহিঙ্গা শিশুরা সেনা সদস্যদের কাছে ঘেঁষতে চাইত না। কারণ তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা দেখেছে। তাই পোশাক পরা সেনা সদস্যদের দেখলেই এক ধরনের ভীতি তাদের মধ্যে কাজ করেছে। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মানবিকতায় রোহিঙ্গা শিশুদের ভয় কেটে যায়। এই দৃশ্য এখানে বিরাজ করছে।
×