ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে শরীয়তপুরে

দৃশ্যমান হলো কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর সাড়ে চার শ’ মিটার

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১২ মার্চ ২০১৮

দৃশ্যমান হলো কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর সাড়ে চার শ’ মিটার

মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল, আবুল বাশার ও সুবল বিশ্বাস ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর তৃতীয় স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ কোটি মানুষের প্রাণের দাবি স্বপ্নের পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেছেন। পদ্মাসেতুর কাজ এখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। রবিবার সকালে পদ্মা সেতুর তৃতীয় স্প্যান শরীয়তপুরের জাজিরা অংশে ৩৯ ও ৪০ নং খুঁটির ওপর বসানোর ফলে মূল পদ্মা সেতুর সাড়ে ৪শ’ মিটার দৃশ্যমান হলো। সকাল ৮টা থেকে স্প্যানটি খুঁটির ওপর বসানোর কাজ শুরু হয়। এরপর সাড়ে ৯টার দিকে ক্রেন থেকে খুঁটির ওপর রাখা হয় স্প্যানটি। সকাল ৮ টা থেকেই ৩ হাজার ৬শ’ টন ধারণক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের জাহাজ “তিয়ান ইয়েহাও” স্প্যান নিয়ে দুই খুঁটির মাঝখানে পজিশন নেয়। এরপর ধীরে ধীরে ক্রেনের সাহায্যে স্প্যানটিকে টেনে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে খুঁটির উপর বসানো হয়। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় স্প্যান ও খুঁটির সঙ্গে সংযুক্তির কাজ। এ সময় পদ্মা সেতুর কাজে নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তারাও নদীতে স্পিড বোট দিয়ে নিরাপত্তাজনিত টহল দিতে থাকে। এর আগে ৩ হাজার ৬শ’ টন ধারণক্ষমতার ভাসমান ক্রেনের জাহাজ “তিয়ান ইয়েহাও” শনিবার দিনভর টেনে এনে পদ্মা সেতুর তৃতীয় স্প্যানটি (সুপার স্ট্রাকচার) ৩৯ ও ৪০নং খুঁটির কাছে চাপানো হয়। স্প্যান বসানোর কাজে দায়িত্বরত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্ভেয়ার মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান জানান, ৩য় স্প্যানটি বসানোর পর এখন কিছু আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা হবে। স্প্যানটি বসানোর পর ৩৯ নম্বর খুঁটির দ্বিতীয় স্প্যানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে ওয়েল্ডিং করে দেয়া হবে। তারা দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ। শীঘ্রই ৪র্থ স্প্যানও বসানো হবে। দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেন তিনি যাতে পদ্মা সেতু সুষ্ঠুভাবে ও নিরাপদে সম্পন্ন করতে পারেন। জানা গেছে, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মোট ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। প্রত্যেক পিলারে ৬টি করে পাইল সাজানো। এদিকে তৃতীয় স্প্যান বসানোর ফলে আনন্দিত শরীয়তপুরের পদ্মা পাড়ের মানুষসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতুর জন্য যারা ভিটে মাটি দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল, যারা এতদিন ভাবছিল পদ্মা সেতু আদৌ হবে কিনা, পদ্মা সেতু একের পর এক স্প্যান বসানোর ফলে বাস্তবে রূপ নেয়ায় তাদের সকল সংশয় কেটে গেছে। তারা বাপ দাদার ভিটে মাটি হারালেও পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দৃশ্যমান হওয়ার পর পদ্মার দু’ পাড়ে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। ইতোপূর্বে দুুটি স্পেন বসানো হয়েছে। আর এ সেতুর কাজ শেষ হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্জলের যোগাযোগ স্থাপন করবে এ সেতু। এতে অর্থনৈতিক চাকা ঘোড়ার পাশাপাশি অসংখ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পদ্মাপাড়ের মোসলেম মাদবর বলেন, তৃতীয় স্পেনটি বসানোর মধ্য দিয়ে আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। আজ আমরা আনন্দিত। পদ্মাসেতু নির্মাণের গতি দেখে মনে হচ্ছে সেতুর কাজ সময়সীমার মধ্যেই শেষ হবে। পদ্মাপাড়ের বাবু বলেন, আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি দিয়েও আমরা আজ শান্তি পাচ্ছি। তৃতীয় স্পেনটি বসানোর ফলে পদ্মাসেতুর কাজ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। এতে মনে হচ্ছে পদ্মাসেতু আমাদের কাছে আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবেই সেতু নির্মাণ করা হবে। এ সেতু নির্মিত হলে আমাদের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে গোটা দেশের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি হবে এ এলাকায়। আমরা আজ খুশি হয়েছি। এদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেয়ার কারণে অবহেলিত ও অনুন্নত শরীয়তপুর জেলা এখন অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে ওঠতে সম্ভাবনার ডানা মেলতে শুরু করেছে। পাল্টে যাবে শরীয়তপুরের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো। বিশেষ করে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার চরজালালপুর মাঝেরচর এলাকার বিশাল চরাঞ্চলকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনৈতিক জোন বা অঞ্চল হিসেবে বাছাই করে নেয়া হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যেই শরীয়তপুরসহ ১০ জেলাকে অর্থনৈতিক জোন বা অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ অর্থনৈতিক জোনের খবরে এলাকায় ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। শরীয়তপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠলে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠাসহ শ্রমজীবী মানুষের অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে উঠবে এসব এলাকায়। সোনালি সেতুর শ্যামল ভূমির এ জেলা হবে দেশের অন্যতম একটি ব্যবসায়িক ও পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যোগ দিবে এ অঞ্চলে। আর মেঘনার পাড়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে চিত্তবিনোদনের জন্য মানুষের মনে স্থান করে নিবে শরীয়তপুর জেলা। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বড় বড় ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলকে ঘিরে নানা পরিকল্পনা করছে। তারা সময়োপযোগী ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি, হিমাগার, ট্যানারি শিল্প কারখানসহ নানাবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে জমি ক্রয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আশা করছেন শরীয়তপুর হবে বাংলাদেশর জন্য বিশাল একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আর দেশের অন্যতম সামুদ্রিক বন্দর মংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে মালামালা পরিবহনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে শরীয়তপুরের সঙ্গে। এ কারণেই স্থানটিকে সরকার প্রাধান্য দিয়ে বাছাই করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বেট্যানারীর চেয়ারম্যান সামসুর রহমান শাহজাদা বলেন, এ জেলায় অর্থনৈতিক জোন হলে ব্যাপক উন্নয়ন হবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অর্থনৈতিকভাবে এ জেলা হবে দেশের অন্যতম। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুর রব মুন্সী বলেন, শরীয়তপুরকে অর্থনৈতিক জোন করা হলে রাতারাতি শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠবে। শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতু প্রথম স্প্যানটি বসেছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এর প্রায় ৪ মাস পর চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় স্প্যানটি বসে। আর মাত্র ৪২ দিন পর রবিবার শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ধূসর রঙের তৃতীয় স্প্যানটি বসানো হলো। এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটের যাত্রীদের ও পদ্মা পাড়ের মানুষ স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখে আনন্দিত। দ্বিতীয় স্প্যানটি বসাতে প্রকৌশলীদের সময় বেশি লাগলেও তৃতীয় স্প্যানটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে পিলারের ওপর বসাতে সক্ষম হয়। প্রথম স্প্যান বসাতে প্রকৌশলীদের বেশি সময় লাগলেও আস্তে আস্তে সময় কম লাগছে। দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন বাকি স্প্যান বসাতে আরও কম সময় লাগবে। শুকনো মৌসুমের সুবিধা কাজে লাগাতে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে মাওয়া প্রান্তের পাইলিংয়ের কাজ এগিয়ে রাখতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সকালে স্প্যান বহনকারী ক্রেনটিকে ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের সামনে পজিশন অনুযায়ী আনা হয়। এরপর লিফটিং ক্রেনের সাহায্যে অস্থায়ী বেয়ারিংয়ের ওপর রাখা হয় স্প্যানটিকে। তবে স্থায়ীভাবে বসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। এছাড়া স্প্যান ওঠানোর আগে ওয়েট টেস্ট, ট্রায়াল লোড টেস্ট, বেজ প্লেট, পাইল পজিশন, মেজারমেন্টসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়। সাময়িক সময়ের জন্য নৌরুটে নৌযানগুলোর গতি কমিয়ে চলাচল করতে বলা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (ডিডি) মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল থেকেই দেশী-বিদেশী প্রকৌশলীরা তৃতীয় স্প্যানটি বসানো কাজ শুরু করেন। কোন জটিলতা ছাড়াই সফলভাবে স্প্যান পিলারের ওপর বসানো হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে ৪২ পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এই সেতুর কাঠামো এবং সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। মাদারীপুর ॥ তৃতীয় স্প্যান বসানোর পর সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতে ১৫০ মিটার দৈর্ঘের স্প্যানটি তিন হাজার ১৪০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন দিয়ে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং কুমারভোগ ইয়ার্ড থেকে জাজিরার নাওডোবা প্রান্তে স্প্যানটি আনা হয়। জনসধারণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে জাজিরার মঙ্গলমাঝি-সাত্তার মাদবরঘাট থেকে লৌহজং-এর শিমুলিয়া ঘাটের সঙ্গে সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। শনিবার বেলা ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তবে বিকল্প একটি চ্যানেল ব্যবহার করে ট্রলার ও স্পীডবোট চলাচল করেছে। রবিবার ভোরে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির কাছাকাছি ক্রেনটি নেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ক্রেন দিয়ে ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপরে স্প্যানটি তোলার কাজ শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্প্যানটি পুরোপুরি খুঁটির ওপর স্থাপন করা হয়। একটার পর একটা স্প্যান বসানোর কারণে এলাকার মানুষ অনেকটা খুশি। তারা বলছেন জমাজমি হারিয়েও পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান দেখে তারা এখন অনেকটা সন্তুষ্ট।
×