ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসন নীরব

মধুপুর শালবনে শতাধিক করাতকল ॥ গাছ উজাড়

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১১ মার্চ ২০১৮

মধুপুর শালবনে শতাধিক  করাতকল ॥ গাছ উজাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ১০ মার্চ ॥ দেশের অন্যতম বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন ঐতিহ্যবাহী মধুপুর শালবন চরম বিপন্ন দশায় পতিত হচ্ছে। এ বনের মোট পাঁচ ভাগের চার ভাগই উজাড় হয়ে গেছে। যেসব কারণে এই বৃহত্তর বন উজাড় হচ্ছে তার মধ্যে অবৈধ করাতকল অন্যতম। মধুপুরে সরকারী নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে করাতকল (স-মিল)। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অবৈধ করাতকল গড়ে উঠলেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। সরকারী বিধিমালা না মেনেই পরিচালিত হচ্ছে করাতকলগুলো। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগ দুর্বৃত্তদের সহায়তা করে থাকে। কখনও রহস্যজনক কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে স্থানীয় প্রশাসন। বন বিভাগের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা মিল মালিকদের নিকট থেকে মাসোয়ারা আদায় করে। এতে করে লাভবান হয় অসাধু কর্মকর্তা ও মিল মালিকরা। বনায়ন এলাকায় অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক অবৈধ করাতকল। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই বনে রাতের আধারে নিমিষে সাফাই করা হচ্ছে সামাজিক বনায়নের গাছ। বন অধিদফতর ও কয়েকটি সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, হাজার বছরের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী বনাঞ্চলের পর দেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন মধুপুর শালবন। এ বনকে দেশের মধ্যাঞ্চলীয় বনভূমি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ বনের বিস্তৃতি গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জুড়ে। এক সময় রাজধানী ঢাকার কাটাবন পর্যন্ত এ বনের সীমানা থাকলেও আজ তা শুধুই অতীত, বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অংশটুকু মধুপুর গড় বা শালবন নামে পরিচিত। শালগাছের মূল বা শিকড় থেকে গজানো চারায় গাছ হয় বলে স্থানীয়রা একে গজারী বনও বলে থাকে। মধুপুর ডিগ্রী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, এ বনে গজারী গাছ নেই। মধুপুরকে শালবন বলেই জানি। স্থানীয় ভাষায় গজারী বন বলা হয়। মধুপুর বনের বর্তমান আয়তন সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই বন বিভাগে। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ধারণা করে মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, মির্জাপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও ভালুকার কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৬২ হাজার ৫শ’ একর বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে কাগজ-কলমে মধুপুর শালবনের আওতায় রয়েছে ৪৫ হাজার ৫৬৫ দশমিক ৩৮ একর বনভূমি। এই বিশাল বনভূমির প্রায় ৩৫ হাজার একর এখন অবৈধ জবরদখলকারীদের হাতে চলে গেছে। বন উজাড় হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ছল-ছুঁতোয় বনাঞ্চলের ভূমিও বেদখল হয়ে গেছে। বেসরকারী সংস্থা ঢাকা ইনস্টিটিউট অব কালচারাল এ্যাফেয়ার্স (ঢাকা আইসিএ) ও গ্লোবাল ফরেস্ট কোয়ালিশন নেদারল্যান্ডসের (জিএফসি) তথ্য অনুযায়ী, মধুপুর শালবনের আয়তন ছিল প্রায় ৪৬ হাজার একর। এখন অস্তিত্ব রয়েছে মাত্র ৯ হাজার একরের। এ হিসেবে মোট বনভূমির পাঁচ ভাগের চার ভাগই উজাড় হয়ে গেছে ও এই বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে বিমান বাহিনীসহ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান। সরেজমিন পরিদর্শন ও অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বন ধ্বংসের পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নদের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতায় টাকার বিনিময়ে দখলে সহায়তা করে একশ্রেণীর বন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বন বিভাগের সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখানে হয় ‘অবৈধ বাণিজ্যের’ ভাগ নিতে হয়, নয় তো চুপ থাকতে হয়। স্থানীয় ও পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ গাছচোর ও ভূমিখেকোদের পক্ষপাতিত্ব করার অনেক অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা বলছে, পেশাদার গাছচোর ও কাঠ পাচারকারীরা দিনের চেয়ে রাতের আঁধারে তাদের অপকর্ম সারলেও এসব গাছ ও কাঠ নিয়ে মজুদ করা হয় বন এলাকার স’মিলগুলোতে। আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে পুলিশ ও বন বিভাগের সঙ্গে অলিখিত চুক্তির ভিত্তিতে গাছচোরেরা বিশেষ ধরনের টোকেন ব্যবহার করে থাকে। মধুপুর বনের গাছ লোপাটের ‘চক্র কাহিনী’ এখন সবারই জানা থাকলেও তা ভেঙ্গে স্থায়ী উদ্যোগ নেই। সরেজমিনে দেখা যায়, বন এলাকার মধ্যে কোন প্রকার করাতকল না থাকার কথা থাকলেও উপজেলার চারটি বিটে শতাধিক করাতকল রয়েছে। শুধু মহিষমারা বিটের মধ্যেই রয়েছে ৩৯টি কলাতকল। এই বিটের শালিকা বাজারে ৪টি, গারো বাজারে ৬টি, জয়নাতলী বাজারে ৪টি, চাপড়ি বাজারে ২টি, নেদুর বাজারে ৩টি, মোটের বাজারে ৬টি করাতকল রয়েছে। শালিকা বাজারের করাতকলের মালিক মোতালেব হোসেন, মোহাম্মদ আলী ও আমজাদ আলী জানান, বন কর্মকর্তা ও নেতাদের টাকাপয়সা দিয়ে মিল চালাতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক করাতকল মিস্ত্রি জানান, প্রতিমাসে বিট কর্মকর্তাকে টাকা দিতে হয়। কুড়ালিয়া বাজারের সোহেল রানা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আহম্মদ আলীকে টাকা দিয়ে অবৈধভাবে সোহেল স’মিলের নামে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। অবৈধ করাতকলকে ইউনিয়ন পরিয়দ ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারে কিনা জানতে চাইলে কুড়ালিয়া ইউপি সচিব আনোয়ার হোসেন জানান, অবৈধ ব্যবসাকে লাইসেন্স দেয়ার নিয়ম নেই। এমনটি হয়েছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখব। মহিষমারা বিট কর্মকর্তা সুজাত আলীকে মিলপ্রতি ২ হাজার টাকা মাসোয়ারা দিতে হয় বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানিয়েছেন। এ অভিযোগ অস্বীকার করে মহিষমারা বিট কর্মকর্তা সুজাত আলী বলেন, মিল চালাতে নিষেধ করি বলে মালিকরা মিথ্য অভিযোগ করেছেন। জয়নাতলী বাজারের মিল মালিক নজরুল ইসলাম জানান, আমাদের মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু এসহাক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলম খানের নাতি। মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু এসহাক সত্যতা স্বীকার করে বলেন, স্থানীয় এমপি এবং ইউএনও একবার করাতকল বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেননি। মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার সরোয়ার আলম খান আবু বলেন, বন ধ্বংস হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত নয়। মধুপুরের প্রশাসন ও বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মধুপুর বন উজাড় হচ্ছে। চাড়ালজানি বিট কর্মকর্তা আনিছুর রহমান অবৈধ করাতকল বন্ধ না করার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জানান, একবার ৫টি করাতকলের চাকা খুলে আনলে স্থানীয় নেতাদের নিকট লাঞ্ছিতও হয়েছেন বলে দাবি করেন। সহকারী বন কর্মকর্তা (এসিএফ) এমএ হাসান বলেন, আমরা বনের ভেতর অবৈধ করাতকল বন্ধের চেষ্টা করছি। উপজেলা প্রশাসনের সঙেঙ্গ যোগাযোগ করে অচিরেই এর একটি ব্যবস্থা নেব। মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস জানান, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সজাগ না হলে প্রশাসনের একার পক্ষে বন রক্ষা করা যাবে না। এসিএফের সঙ্গে আলোচনা করে দেখব কিভাবে এই ঐতিহ্যবাহী বনকে রক্ষা করা যায়। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হোসাইন মুহম্মদ নিশাদ বলেন, যদি কোন বন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বন অপরাধের কোন অভিযোগ আসে। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নেব। এ বিষয়ে কোন ছাড় নেই। তবে অবৈধ করাতকলের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
×