ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছুরিকাহত জাফর ইকবাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৪ মার্চ ২০১৮

ছুরিকাহত জাফর ইকবাল

গাফফার খান চৌধুরী/সালাম মশরুর/হোসাইন ইমরান ॥ বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার ওপর হামলা চালানো হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামলার ধরন বলছে এটি জঙ্গী হামলা। জাফর ইকবালকে নিশ্চিতভাবে হত্যার উদ্দেশেই তার মাথায় হামলা চালানো হয়েছে। হামলাকারী জনতার হাতে ধরা পড়েছে। গণধোলাইয়ে আহত হামলকারীকে উদ্ধার করা হয়। পরে জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রাতে তাকে র‌্যাব ও পুলিশের হেফাজতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয় বলে হাসপাতালসূত্রে জানা যায়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত এগারো জন ছাত্রকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে চিহ্নিত করা হয়। হামলাকারী চিহ্নিত সেই এগারো জনেরই একজন কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। এছাড়া সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে র‌্যাগিংয়ের দায়ে শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তির পরিমাণ কম হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল। এসব কারণে হামলার ঘটনাটি ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ছত্রছায়ায় জঙ্গী সংগঠনগুলো অত্যধিক তৎপর বলে নানাভাবে প্রকাশ পায়। জঙ্গী হামলার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র গ্রেফতারও হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে সারাদেশে ব্লগার, প্রকাশক, লেখকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে ঘটনাটি ঘটে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় শুক্রবার ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলছিল। শুক্রবার অনুষ্ঠানের বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে উদ্বোধন করেছিলেন ড. জাফর ইকবাল। শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চ এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিকেল পাঁচটায় মঞ্চে ওঠার সময় পেছন থেকে মাথায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয় জাফর ইকবালকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। তাকে দ্রুত সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। রক্তক্ষরণের সময় জাফর ইকবাল কথা বলছিলেন। হামলাকারী দ্রুত কয়েক দফায় জাফর ইকবালের মাথায় ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। এ সময় ধাওয়া করে আশপাশে থাকা ছাত্র শিক্ষকরা হামলাকারীকে ধরে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদ হাসান জানান, হামলাকারীকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জহির উদ্দিন আহমেদ জানান, মঞ্চের পেছন থেকে এসে এক ছেলে জাফর ইকবালের মাথা, মুখ ও বুক লক্ষ্য করে ছুরি মারতে থাকে। কি কারণে জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা হয়েছে সে বিষয়ে কোন কিছুই জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ সেশনের ছয় নবীন শিক্ষার্থীকে রাত ১০টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত আটকে অর্ধনগ্ন করে রাখে একদল শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে তাদের জোর করে অর্ধনগ্ন ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অশ্লীল ক্যাপশন দিয়ে একটি গ্রুপে পোস্ট করা হয় এবং বেশ কিছু সময় পরে ডিলিট করা হয়। বিষয়গুলো কাউকে বললে তাদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ার দেন সিনিয়ররা। তারই প্রেক্ষিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শাবি সিন্ডিকেটের সভায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী হামিদুর রহমান রঙ্গন এবং আশিক আহমেদ হিমেলকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়াও ১৯ জনকে দ- প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় শাবি প্রশাসন। র‌্যাগিংয়ের শাস্তি কমানোর দাবিতে প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করে আসছিল শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে তারা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। র‌্যাগিংয়ের দায়ে শাস্তি পাওয়া ছাত্রদের শাস্তি কম হয়েছে বলে জাফর ইকবাল মন্তব্য করেছিলেন। শাস্তি পাওয়া ছাত্রদের পুলিশে দেয়া উচিত ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। র‌্যাগিংয়ের ক্ষোভকে পুঁজি করে কোন জঙ্গী গোষ্ঠী এমন ঘটনা ঘটাতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। হামলার পেছনে জঙ্গীদের হাত থাকতে পারে বলেও তাদের সন্দেহ। কারণ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগারো শিক্ষার্থীকে গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শনাক্ত করেছেন। যারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বর্তমানে আনসার আল ইসলামের সদস্য। তারা উগ্র জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। তাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে সিলেটের সুবিদবাজারে নৃশংসভাবে হত্যা করে জঙ্গীরা। হত্যাকারীদের একজন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। জঙ্গীবাদের বিষয়ে বরাবরই সোচ্চার জাফর ইকবাল। তারই ধারাবাহিকতায় হামলার ঘটনাটি ঘটতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকেই। হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাড়তি উত্তেজনা বিরাজ করছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন। সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম স্বপন জানান, ক্যাম্পাসে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভাংচুর করছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর থেকেই জঙ্গীদের হাতে একের পর এক খুন ও হামলার শিকার হতে থাকেন ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজিব, সিলেটের বাসিন্দা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন সামাদ, বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপ, ব্লগার অভিজিত রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়, কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও তনয়কে হত্যা, মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিনজনকে আহত করাসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটে। প্রতিটি হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১২ মে সকাল সাড়ে আটটার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে জঙ্গীরা। অনন্তকে হত্যার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের শাখার (একিউআইএস) নামে আনসারুল্লাহ বাংলা-৮ নামের একটি আইডি থেকে টুইট করে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। অনন্ত হত্যায় মান্নান ইয়াহিয়া (২৪) ও তার ভাই মোহাইমিন নোমান (২১) সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়। ইয়াহিয়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ছিল। ২০০৯ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমে ছাত্র শিবির পরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। আর নিহত অনন্ত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে মাস্টার্স করার পর পূবালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অনন্তকে টার্গেট করেছিল জঙ্গীরা। পড়াশোনা করার সময় অনন্তকে হত্যা করতে পারেনি। পরে তাকে সুযোগ বুঝে হত্যা করে। দীর্ঘ সময় পর অনন্তকে হত্যা করে জঙ্গীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সামাদকেও সিলেটেই হত্যার টার্গেট করেছিল। সেখানে সফল না হওয়ায় ঢাকায় তাকে সুযোগমতো হত্যা করে জঙ্গীরা। এর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেরুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে একইভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক হুমায়ুন আজাদকে। এছাড়া গলা কেটে হত্যা করা হয় বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে। আর ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর আয়না মহল নামের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার ২টি কক্ষে গলা কেটে হত্যা করা হয় ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্বত্রাণ কর্তা দাবিদার লুৎফোর রহমান ফারুক (৫৫), তার ছেলে বেসরকারী সিটি ব্যাংকের সদরঘাট শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সানোয়ারুল ইসলাম মনিরসহ (৩০) ছয় জনকে। কে এই হামলাকারী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীর পরিচয় মিলেছে, তার নাম ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল (২৪)। ফয়জুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা। তার মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। শনিবার সন্ধ্যায় ফয়জুলের শেখপাড়ার বাসাটিতে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরপরই শেখপাড়ার বাসাটিতে তালা মেরে ফয়জুলের পরিবারের সবাই চলে গেছে। বাসাটি তালাবদ্ধ। কুমারগাঁও বাসস্টেশনের দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ফয়জুলের পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে চলে যেতে দেখেছেন। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, মেডিক্যালে যাচ্ছি। এলাকাবাসী জানায়, ফয়জুল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলে এলাকায় পরিচয় দিত। তবে কোন মাদ্রাসায় পড়ে এ বিষয়ে এলাকার কেউ জানাতে পারেননি। ফয়জুলের বাবা মাওলানা হাফিজুর রহমান সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্ববর্তী টুকেরবাজারে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। শনিবার রাত নয়টার দিকে হাফিজুরের মুঠোফোনে ফোন দিলে ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেননি। পরে আবারও ফোন দিলে সেই মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
×