ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৯৩ হাজার বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৯৩ হাজার বাংলাদেশী

ফিরোজ মান্না ॥ দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ৯৩ হাজারের বেশি মানুষ পাড়ি জমিয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই মানুষগুলো ইউরোপ গেছেন। এ সংখ্যা বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় অনেক বেশি। অবৈধদের ফেরত আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর গত কয়েক মাস ধরে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। বাংলাদেশ অবৈধদের ফেরত আনার বিষয়ে ইইউর সঙ্গে একমত হলেও কোন কর্মীকে এখন পর্যন্ত ফেরত আনেনি। এ কারণে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইইউর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের ও ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচী এ তথ্য জানিয়েছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঠিক কতসংখ্যক বাংলাদেশী আছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ইইউর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৯৩ হাজারের বেশি মানুষ সাগর পথসহ অন্যান্য পথে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। তারা ইউরোপের দেশগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বহু মানুষ ইউরোপের অনেক দেশে জেলও খাটছেন। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য গত বছরের এপ্রিলে ইইউ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। সেই সময় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে একটি হিসাব তুলে ধরেন। তারা তখন বাংলাদেশ থেকে নানা ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে ৯০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরো স্টেটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-২০১৭ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশী ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এ বছরের এক মাস ধরলে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগর পথ পাড়ি দিয়ে (সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট) দিয়েই বেশির ভাগ বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এ দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সূত্র জানিয়েছে, দেশে ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে একটি আইন করা হয়েছে। একই সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। কিন্ত এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশের তথ্য আনুযায়ী, মানবপাচারের সাড়ে ৩ হাজার মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জনের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছে। এতগুলো মামলার মধ্যে মাত্র ৩০ জনের শাস্তি হয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করা উচিত। তা না করা হলে এভাবেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। অনেক সময় পুলিশ প্রতিবেদন সঠিকভাবে আসে না। সেক্ষেত্রে আদালতের কিছুই করার থাকে না। ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন মনে রাখতে হবে মানবাধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন রামরু জানিয়েছে, মানবপাচারে দেশে-বিদেশে বড় বড় স্বার্থগোষ্ঠী অনেক ক্ষমতাধর। এজন্য টার্গেট করে মূল হোতাদের খুঁজে বের করা উচিত এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। মানবপাচারের মতো ঘটনার যখন অপরাধীরা শাস্তি পায় না তখন তারা আরও বেশি উৎসাহ নিয়ে অবৈধভাবে মানবপাচার করে। মূল হোতাদের একজনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে ১০ জন সতর্ক হয়ে যাবে। তখন তারা অপরাধ করতে চিন্তা করবে। বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে দিনের পর দিন মানবপাচার করে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান না ঘটলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। রামরুর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলা হলেও কোন প্রতিকার হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অবৈধ পথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় তুরস্কে গিয়ে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী আটকা পড়েছেন। ইউরোপের এ চিত্রের পাশাপাশি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়া এবং সেখানকার গণকবরের কথা চিন্তা করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। মালয়েশিয়াও সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে গত বছরের জুন থেকেই। চলমান অভিযানে হাজার হাজার বাংলাদেশী কর্মী আটক হয়েছে। বহু কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অভিযান সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই চলমান রয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশী বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। গত বছর মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। ওই প্রতিবেদনে দেশগুলোকে তিনটি স্তর বা টায়ারে ভাগ করা হয়। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-টু)। এবার এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরের ‘নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় (টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট)’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ ৪৫টি দেশ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তখন এ চিত্র উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে।
×