ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্কাহীন প্রাণের মেলা, বন্ধের দিনে বিপুল সমাবেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শঙ্কাহীন প্রাণের মেলা, বন্ধের দিনে বিপুল সমাবেশ

মোরসালিন মিজান ॥ পুরনো কথাটিই বলতে হবে। বলতে হবে, ঢল নেমেছিল মানুষের। আগের দিনের শঙ্কা কাটিয়ে শুক্রবার বন্ধের দিনে হাত ধরাধরি করে মেলায় এসেছেন নারী-পুরুষ শিশুরা। সব বয়সী মানুষের প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে- বাঙালীর প্রাণের মেলা শঙ্কাহীন। আইন আদালতের কনসেপ্ট দেশে যথেষ্ট দাঁড়িয়েছে। জাগ্রত হয়েছে ন্যায় অন্যায়ের বোধ। রাজনীতি তাই রাজনীতির মাঠেই ছিল। মেলা ছিল মেলার জায়গায়। অগনিত মানুষের সমাবেশ দেখে মেলার বাকি দিনগুলো কেমন যাবে, সে ধারণাও পাওয়া গেল। নবম দিনের মেলা শুরু হয় শিশুপ্রহর দিয়ে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে চলে এসেছিল ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু কর্নারে গিয়ে দেখা যায়, উপচেপড়া ভিড়। কল্পনার রাজ্য সিসিমপুরের জনপ্রিয় চরিত্র টুকটুকি ও হালুমের সঙ্গে খেলছিল সোনামনিরা। নাচ গান হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বইয়ের গল্প। গল্পের ছলে শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। পুরো বিষয়টি ছিল দারুণ উপভোগ্য। এর বাইরে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন অধ্যাপক নিসার হোসেন। প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় ৩০০ জন, খ-শাখায় ২৭৫ জন এবং গ-শাখায় ১১২ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। সব মিলিয়ে ৬৮৭ জন প্রতিযোগী। পরে সবাই বই দেখে বই কিনে মজার সময় পার করে। লালমাটিয়া থেকে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন আসিফুর রহমান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, শুক্রবার ছাড়া সময় পাই না। তাই ছুটির দিনে ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছি। কয়েকটা ছবির বই কিনে দিয়েছি। ও পাতা উল্টে বুঝতে পেরেছে, এগুলো স্কুলে বই নয়। তারপর নিজেই বিভিন্ন বই পছন্দ করছে। কিনে দেয়ার বায়না ধরছে। বিকেলে মেলায় কথা হয় আলী আশরাফের সঙ্গে। দেখেই বোঝা যায় বইপ্রেমী। অনেকগুলো বই কিনেছিলেন। বললেন, গতকাল আসতে চেয়েছিলাম। হয়ে ওঠেনি। আজ প্রথম এসেছি। গতকাল কেন আসতে পারেননি ? মনে কোন শঙ্কা ছিল ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো একুশের মেলা। বাঙালীর প্রাণের মেলা। এখানে সারাজীবন এসেছি। আসব। শঙ্কার কথা আসছে কেন ? সম্প্রতি একটি দুর্নীতির মামলার রায় হয়েছে। সে কথার উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামলা মোকদ্দমা আদালতে ফয়সালা হবে। রাজনীতিও থাকবে রাজনীতির জায়গায়। এগুলো মেলায় ঢুকবে কেন ? মনের আনন্দেই মেলায় এসেছেন বলে জানান তিনি। দেখা মিললো জাফর ইকবালের ॥ নবম দিনের মাথায় মেলায় পা রাখেন জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। শুক্রবার বিকেলে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর থেকে যা হবার তাই হয়েছে। শত শত ছেলে মেয়ে পিছু নেয় হেমিলনের বাঁশিওয়ালার। কারও অটোগ্রাফ চাই। কারও চাই ছবি তোলার সুযোগ। দাবি পূরণ করতে করতে সুন্দর হাঁটছিলেন তিনি। পরে গিয়ে বসেন তার বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাম্রলিপির সামনে। ততক্ষণে চারপাশ থেকে অসংখ্য ছেলে বুড়ো ঘিরে ধরেন তাকে। এভাবে মেলা শেষ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে অটোগ্রাফ দেয়া ও ছবি তোলার কাজ। হ্যাঁ, লেখকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ভিড় ঠেলে তা কাছে পৌঁছা চাট্টিখানি কথা নয়। এবং অতঃপর হার মানতে হয়েছে! ৩৪৪ নতুন বই ॥ শুক্রবার হওয়ায় বইয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। মেলার নবম দিনে নতুন বই এসেছে ৩৪৪টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রশীদ উদ্দিন, উকিল মুন্সী, বারী সিদ্দিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুমনকুমার দাশ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কামালউদ্দিন কবির এবং সাইমন জাকারিয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নূরুল হক। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলার গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতিতে, বিশেষত হাওরাঞ্চলে যেসব সাধক লোকায়ত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে আসীন, তাদের মধ্যে উকিল মুন্সী ও রশিদ উদ্দিন অন্যতম। তাদের রচিত গান নাগরিক সমাজে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন যে কয়েকজন হাতে-গোনা ব্যক্তি, এঁদের মধ্যে শিল্পী বারী সিদ্দিকীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক অঞ্চলের এই তিন লোকমনীষার গান রচনা ও সুর সংযোজনা ক্ষুরধার এবং তৃণমূললগ্ন। লোকায়ত বাংলার এই তিন সাধক প্রকৃতই বাঙালীর ঐতিহ্যিক মননবিশ্বের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। আলোচকরা বলেন, কেবল নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও জনজীবনই নয়, সেখানকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের ধারক ও বাহক ছিলেন উকিল মুন্সী ও রশীদ উদ্দিনের মতো বাউল সাধকেরা। রূপকথার আশ্রয়ে তাঁরা বলে গেছেন বিশ্বজগত ও জীবনের নানা নিগূঢ় ও অক্ষয় সত্য। মানবজীবনের প্রেম, ভালবাসা, বিচ্ছেদ-বেদনা ছাড়াও তাত্ত্বিক দিক থেকেও তাঁদের গান ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মানবীয় চেতনা ও মানব-আবেগের মর্মস্পর্শী প্রকাশ তাঁদের গানকে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সভাপতির বক্তব্যে নূরুল হক বলেন, এই তিন গুণী বাউল সাধক ও শিল্পীদের মতো বাংলার পথে-প্রান্তরে আরও অনেক বাউলরতœ লুকিয়ে আছেন। তাঁদের জীবনবোধ ও জীবনচেতনা অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও জাতিসত্ত্বার উৎসের সন্ধান করতে হবে।
×