ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে মিথ্যা ঘোষণায়, আটক হচ্ছে বন্দরে

আমদানি নিষিদ্ধ পিকচার টিউব ছাড়িয়ে নিতে তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আমদানি নিষিদ্ধ পিকচার টিউব ছাড়িয়ে নিতে তৎপরতা

ওয়াজেদ হীরা ॥ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে থেমে নেই নিষিদ্ধ ঘোষিত পুরনো ও ব্যবহৃত সিআরটি টিভির পিকচার টিউব আমদানি। বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন বন্দরে আটকও হচ্ছে। তবুও সময়ে সময়ে প্রবেশ করছে আমদানি নিষিদ্ধ এ পণ্যগুলো। এর ফলে এসব একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা আবার ঠকছেন ভোক্তারা। এছাড়াও স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিতো থাকছেই। কর্তৃপক্ষ বলছে আমরা এ বিষয়ে তীক্ষè নজরদারি রেখেছি। কয়েক মাস আগেও বেশ কয়েকটি কন্টেইনারে পাওয়া যায় এসব পণ্য, যার মামলা চলমান। পুরনো ও ব্যবহৃত সিআরটি টিভির পিকচার টিউব আমদানি নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু তার পরেও থেমে নেই আমদানি। দুই মাস আগেও চট্টগ্রাম ও পানগাঁও পোর্টে আটক করা হয়েছে কন্টেইনার। যেখানে পাওয়া গেছে আমদানি নিষিদ্ধ সিআরটি পিকচার টিউব। মিথ্যা ঘোষণা আর ওভার ইনভয়েসিং করে আমদানি করা এসব পিকচার টিউব ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্রান্ডের নকল লোগো লাগিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে নামী দামী এবং ব্র্যান্ডের টিভি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। জানা গেছে, কিছু দিন আগে আটককৃত কন্টেইনারে পাওয়া গেছে শতশত আমদানি নিষিদ্ধ পিকচার টিউব। যা আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। যা ছাড়িয়ে নিতে ইতোমধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জোর তদবিরও চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। গত ৫/১১/১৭ তারিখে বিল এন্ট্রি করে প্রবেশ করা কন্টেইনার আটক হয় চট্টগ্রামে। যা আমদানি করেন পুরানা পল্টনে অবস্থিত এম এম ইলেকট্রনিক্স। ১৭২৮ পিস পুরাতন পিকচার টিউব আমদানি করে। চায়না থেকে আমাদানি করা হয় বলেও জানা গেছে। এছাড়াও পানগাঁও কাস্টমস হাওজে তিন ধাপে আটক হয় এই পুরাতন পিকচার টিউবের চালান। বিজয় নগরের আমদানিকারক গার্ডেন ইলেকট্রনিক্স ০৯/০৯/১৭ তারিখ বিল এন্ট্রি নং সি-২৪৯৪ নম্বরে ২১ ইঞ্চি টিভি পিকচার টিউব আমদানি করে। যার ঝাড় করানো প্রতিষ্ঠান সিএন্ডএফ ইউনাইটেড ট্রেড এজেন্সি। যারা ২১১২ পিস পুরাতন পিকচার টিউব আমদানি করে। এছাড়াও ২৯/০৮/১৭ তারিখের বিল এন্ট্রি ২৪৩৮ অনুযায়ী আমদানিকারক নোভা ইলেকট্রনিক্স এন্ড হোম এ্যাপ্লায়েন্স কো. যাত্রাবাড়ি, ১০৫৬ পিস আমদানি করে। সিএন্ডএফ ছিল আল ফাতাহ এজেন্সি। মোহাম্মদপুরের আমদানিকারক: অস্কার ইন্ড্রাস্ট্রিজ বিল এন্ট্রি ১৯৬৯ তারিখ ১৩/০৯/১৭ অনুযায়ী ২১১২ পিস আনে যার সিএন্ডএফ দায়িত্ব ছিল উত্তরার ওয়ার্ল্ড ট্রেড লিঙ্ক। এরা প্রত্যেকেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব পুরাতন পিকচার টিউব আমদানি করেছেন বলেও জানা গেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জানিয়েছে, প্রত্যেকের নামে ১৯৬৯ কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে এসব পণ্যের চালান ছাড়িয়ে নিতে ইতোমধ্যেই জোর লবিং চলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন কন্টেইনারে অন্যান্য পণ্যের সাথে এসব পুরাতন টিভি পিকচার টিউব পাওয়ার কারণে আরও প্রায় অর্ধশত কন্টেইনার নজরদারিতে রয়েছে। যথাযথ পরীক্ষার পর তা ছাড় করানোর কথাও জানিয়েছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান। জানা গেছে, আমদানি নীতি আদেশ ২০১২-১৫ এর অন্তর্ভুক্ত আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকার ফুটনোট (৪)-এ পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম কাস্টমস এ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ১৫, ১৬ ও ৩২ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ রয়েছে। একই আইনের ধারা ১৫৬(১)এর ক্লজ ৯ অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, কাস্টমস আইন অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পুরনো পিকচার টিউব নিলামে বিক্রি করারও সুযোগ নেই। এগুলো বাধ্য হয়ে ধ্বংস করতে হয়। ধ্বংস করাও কঠিন বিষয়। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, এসব ছাড়িয়ে নিতে হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ক্লিয়ার পারমিশন (সিপি) দিলে নিতে পারবে তবে তাদের জরিমানা দিতে হবে। যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। যদি আমদানিকারকরা পণ্য ছাড়িয়ে না নেয় সেক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব টাকায় এসব পণ্য ধ্বংস করতে হবে যা অনেক ব্যয়বহুল বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, নতুন পিকচার টিউব কিনতে হয় প্রতিটি ২৯ ইউএস ডলার বা তার চেয়েও বেশি দামে। অন্যদিকে পুরনো পিকচার টিউবের দাম ১০ ডলারেরও কম। বর্তমানে পিকচার টিউব আমদানিতে ৩৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। যেহেতু পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি নিষিদ্ধ, তাই সেগুলো নতুনগুলোর সমান দাম দেখিয়েই বন্দর থেকে ছাড় করাতে হয়। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাকি টাকা ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে টাকা পাচার করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরনো পিকচার টিউব হলো এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ। এসব দিয়ে তৈরি করা টেলিভিশন থেকে নির্গত গামা রশ্মি দেহ ও চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে পুরনো পিকচার টিউবের অতিবেগুনি রশ্মি ওজন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিবেশ বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখে। একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই পিকচার টিউব ব্যবহৃত হয় শুধু সিআরটি (ক্যাথড রে টিউব) টেলিভিশন তৈরিতে। আগে বিভিন্ন দেশে এই পিকচার টিউব তৈরি হলেও বর্তমানে কেবল চীনের একটি প্রতিষ্ঠান টিজিডিসি এটি তৈরি করছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার আশায় স্বল্পমূল্যে পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি করছেন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত টিভি উৎপাদন ও সংযোজনকারী দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো। সূত্র জানিয়েছে, প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে যেসব স্থানীয় উদ্যোক্তা টেলিভিশন সংযোজন ও উৎপাদন কারখানা গড়ে তুলেছেন তারা স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন এসব কারণেও। একদিকে তারা বাজার হারাচ্ছেন, অন্যদিকে তাদের বিনিয়োগও ঝুঁঁকির মধ্যে পড়ছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে তানিন, নিপ্পন, প্যাসিফিক, এনইসি, নিক্কনের মতো অনেক ব্র্যান্ডের টেলিভিশন প্রস্ততকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ টেলিভিশন ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বর্তমান কমিটির কারো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নাম প্রকাশ না করে সাবেক এক নেতা বলেছেন, গুটিকয়েক অসৎ ব্যবসায়ী পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি করেন। আবার তা বিভিন্ন ব্রান্ডের নামে চালিয়ে দেন। ক্রেতারাও ঠকছেন। এর জন্য দৃষ্টান্ত শাস্তি প্রয়োজন বলেও জানান। পিকচার টিউব ছাড়করণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন বলে জানা গেছে কাস্টমস কমিশনাররাও।
×