ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ২শ’ স্পটে ৫০ ছিনতাইকারী দলের ৩শ’ সদস্য তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

ঢাকার ২শ’ স্পটে ৫০ ছিনতাইকারী দলের ৩শ’ সদস্য তৎপর

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর ঢাকা মহানগরীর ৪৯ থানা এলাকার ২ শতাধিক স্পটে অন্তত ৫০টি ছিনতাইকারী দলের ৩ শতাধিক সদস্য বেপরোয়া সক্রিয়। প্রতিমাসে গড়ে ২০টির বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। রাজধানীতে ছিনতাইকারী দলের হাতে কয়েকজন নিহত হওয়ার ঘটনা ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে গৃহবধূ হেলেনা বেগম ও সায়েদাবাদে ব্যবসায়ী ইব্রাহিম ছিনতাইকারী দলের সদস্যদের হাতে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীসহ রাজধানী ঢাকার ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের ধরতে চেকপোস্ট, ব্লকরেইড, পুলিশের টহল বৃদ্ধি, গ্রেফতারসহ সাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কোটি জনসংখ্যার অধিক অধ্যুষিত ছিনতাইকারী দল ও দুর্বৃত্ত মুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেয়ার পর পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট তৎপরতা শুরু করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিএমপি সূত্র জানান, হঠাৎ করেই রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। ছিনতাইকারী চক্র এতই বেপেরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এ দুর্বৃত্ত দলের সদস্যরা ছিনতাই কাজে বেড়ে গেছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও। এসব ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল। ছিনতাইকারী চক্রের টার্গেট মহিলাদের ভ্যানিটিব্যাগ, ব্যাগভর্তি টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল ফোনসেট। রাজধানীর ৪৯ থানাধীন এলাকার অন্তত ২ শতাধিক স্পটের যেসব স্থানে ছিনতাইকারী চক্র ওঁৎ পেতে থাকে তার মধ্যে ভোরবেলায় ছিনতাইকারী চক্রের টার্গেট হচ্ছে, সদরঘাট লঞ্চঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে যাতায়াতকারী যাত্রীরা। ভোরবেলার যাত্রীদের টার্গেট করছে ছিনতাইকারী চক্র। রাতভর মাদকসেবন করে ছিনতাইকারী চক্র কাকভোরে নামে ছিনতাইয়ে। ছিনতাই তো হচ্ছেই, বাধা দিলেই হতাহতের ঘটনা নিশ্চিত। রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা, বাড্ডা, বনানী, খিলক্ষেত, ভাষানটেক, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, দারুস সালাম, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, গুলিস্থান, রামপুরা, হাজারীবাগসহ মহানগরীর থানা এলাকায় অন্তত দুই শতাধিক ছিনতাইয়ের স্পটগুলোতে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অতর্কিত হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ছিনতাই হচ্ছে। ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনে এসব ছিনতাইয়ের স্পট আর জায়গায় সক্রিয় রয়েছে ছিনতাইকারী চক্র। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের কলেজ গেট থেকে রিং রোড, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে মিরপুর-১, আগারগাঁও সংযোগ সড়ক, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক, কালশী রোড, মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার, সদরঘাট থেকে সূত্রাপুর, সদরঘাট থেকে দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, উত্তরা থেকে আব্দুল্লাহপুর, ঝিগাতলা থেকে রায়েরবাজার, ঝিগাতলা থেকে শংকর, মিরপুরের রূপনগর বেড়িবাঁধ, গুলিস্তান থেকে পল্টন, সার্ক ফোয়ারা থেকে রমনা পার্ক, কাঁটাবন থেকে নীলক্ষেত, পলাশী থেকে আজিমপুর এবং যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড় থেকে শ্যামপুর এলাকায় টানা পার্টি বেশি সক্রিয়। এসবের মধ্যে রমনা, পল্টন, হাইকোর্ট মোড়, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রোড, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড ও মৌচাক এলাকায়ও সাদা গাড়ি নিয়ে টানা পার্টি সক্রিয়। ভুক্তভোগীরা বলছে, ভোরে রাস্তায় পুলিশের টহল থাকে না। নির্ধারিত চেকপোস্টেও থাকে না পুলিশ। কিছু এলাকায় রাতে ও ভোরে চেকপোস্ট থাকলেও সেখানে ট্রাফিক পুলিশের মতোই কেবল গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করা হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবাধে অপরাধ করছে ছিনতাইকারীরা। ডিএমপির সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনার সুর্নিদিষ্টভাবে পুলিশের কাছে সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই । কারণ ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সত্ত্বেও মানুষ বাধ্য না হলে থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেন না হয়রানি হওয়ার ভয়ে। অনেকে ছোট খাটো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও থানায় বিষয়টি অবহিত করেন না। ফলে ছিনতাই বৃদ্ধির বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কাছেও অনেকাংশে অজানা থেকে যাচ্ছে। পুলিশের কাছে যে পরিসংখ্যান আছে তাতে প্রতিমাসে রাজধানীতে ২০ থেকে ২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের হিসাব মতে, ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনা পুুলিশের হিসাবের চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি অর্থাৎ শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা ভ্যানিটি ব্যাগ, ব্যাগ, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে। ছিনতাইকারীর থাবায় পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন কেউ কেউ। রাজধানীর অন্তত দুই শতাধিক ছিনতাই স্পটে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব ছিনতাইকারী চক্রের প্রত্যেকটি দলে ৫ থেকে ৭ জন করে সদস্য রয়েছে। যারা বিভিন্ন স্পটে শিকারের আশায় ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের কেউ কেউ মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়েও সংশ্নিষ্ট এলাকায় টহল দিতে থাকে। বিশেষ করে ভোর বেলা লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে করে যারা ঢাকায় আসছেন কিংবা ঢাকার বাইরে যান তাদের টার্গেট করা হয়। এ ছাড়া ট্রাফিক সিগন্যালে কিংবা ব্যস্ততম সড়কে যানজটের অপেক্ষায় থাকে ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, শুক্রবার ভোরে ধানমন্ডিতে স্বামীর সামনে এমন মর্মান্তিকভাবে মারা যাওয়া স্ত্রী হেলেনা বেগম। এর প্রায় ঘণ্টা তিনেক আগে সায়েদাবাদে ছিনতাইকারী দলের ছুরিকাঘাতে নিতহ হলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ছিনতাইকারী দলের হাতে দুই জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা পুলিশের উর্ধতন মহলে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া একই দিন সন্ধ্যায় হাজারীবাগে ছুরিকাহত হয়েছেন জাকির হোসেন নামে এক তরুণকে ছুরিকাঘাত করে ওই সময় তাঁর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মগবাজার এলাকায় ডিবির পরিচয়ে দুর্বৃত্তরা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করার সময়ে জনতার ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায়। এর আগে রাজধানীর দয়াগঞ্জে ছিনতাইকারী দলের ছিনতাইয়ের সময়ে হ্যাঁচকা টানে মায়ের কোল থেকে শিশু পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনার পর ছিনতাইকারী দলের প্রধান আসামি রাজীবকে গ্রেফতারসহ এক ডজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়। ছিনতাইকারী দলের প্রধান রাজীবকে গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, শুক্রবার ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডি ও সায়েদাবাদে ছিনতাইকারী দলের হাতে দুই জনের মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় ছিনতাইকারী দলের সদস্যদের গ্রেফতারসহ রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইসহ সকল অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ছিনতাইকারী দলের সদস্যদের ধরতে রাজধানীতে চেকপোস্ট, ব্লকরেইড, টহল পুলিশ বৃদ্ধিসহ এলাকাভিত্তিক ছিনতাইয়ের ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকার ছিনতাইয়ের যেসব এলাকা বা স্পটকে শনাক্ত করা গেছে সেখানে এলাকায় কারা ছিনতাই করছে তা খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ ও ডিবি। হালনাগাদ করা হচ্ছে ছিনতাইকারীদের তালিকা। ছিনতাইকারী চক্রসহ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ছিনতাইকারী চক্রের অনেক সদস্যসহ অপরাধী চক্রের সদস্যরা অভিযানের জালে আটকা পড়ছে বলে এ ডিবি কর্মকর্তার দাবি।
×