ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রুমি নোমান

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ স্মৃতিময় সমাবর্তন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ স্মৃতিময় সমাবর্তন

‘নিমেষ তরে ইচ্ছা করে, বিকট উল্লাসে সকল টুটে যাইতে ছুটে, জীবন-উচ্ছ্বাসে’ কবিগুরুর সেই জীবন তথা প্রাণের উচ্ছ্বাস খুঁজে পেতেই যেন গত ৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেছিল প্রাণের মেলা। দীর্ঘ ১৬ বছর পর অনুষ্ঠিত সমাবর্তনকে প্রাণের মেলা না বলে উপায়ই কি? হ্যাঁ, দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ঘুচিয়ে সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ সমাবর্তন। সমাবর্তনকে ঘিরে নবীন-প্রবীণের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল ইবি। হ্যাট, গাউন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়না, মুক্তবাংলা সকল প্রাঙ্গণগুলো মুখরিত হয়েছিল গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায়। সমাবর্তন অনুষ্ঠান, পদক প্রদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবখানেই ছিল গ্র্যাজুয়েটদের জয়ধ্বনি। সমাবর্তনকে ঘিরে নানা রঙে নানা সাজে সেজেছিল ক্যাম্পাস। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর, আকর্ষণীয় সময় ছিল রাতের ক্যাম্পাস। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্যাম্পাস মিটিমিটি রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। ক্যাম্পাসের মেইন গেট, প্রশাসনিক ভবন, ডাইনা চত্বর, মুক্ত বাংলা, পানির ফোয়ারা, ভিসির বাংলো, অনুষদ ভবনসমূহ, আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের মোট ৮টি হলে সারা রাত ছিল মিটিমিটি রঙিন বাতির আলোর ঝলকানি। সমাবর্তনে শিক্ষার্থীসহ সকলের সবচেয়ে নজর কেড়েছে নান্দনিক ‘সততা ফোয়ারা’-র আলোকচ্ছটা। কথা হয়েছিল অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসের আমূল পরিবর্তন। অনেক ভাল লাগছে এখন। বর্তমান প্রশাসনের সকলকে ধন্যবাদ আমাদের এত সুন্দর ক্যম্পাস উপহার দেয়ার জন্য।’ সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে দুপুর সাড়ে ১২টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ সরওয়ার মোর্শেদ ও আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরমিন খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। সভাপতির ভাষণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান কেন্দ্র নয় বরং তা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার শ্রেষ্ঠ পাদপীঠ। শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে এবং তাদের বিশ্ব নাগরিকে পরিণত করতে বিশ্ববিদ্যাালয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কারিকুলামভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মুক্ত চিন্তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা, জাতি গঠনমূলক কর্মকা-, সমকালীন ভাবনা, সাংস্কৃতিক চর্চা খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকা- শিক্ষার্থীদের কেবল দক্ষ ও পরিপূর্ণ করে না, কূপম-ূকতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এনে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা কে পরিপুষ্ট করে।’ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘বাংলাদেশ দারিদ্র্য পীড়িত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ নয়। এই বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে পড়েছে। তোমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনের পরের ধাপে পা দিতে যাচ্ছ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে তোমাদের ধারণা হতে পারে তোমরা বুঝি খুব অল্প খরচে একটা ডিগ্রী পেয়েছ- সেটি কিন্তু সত্যি নয়। তোমাদের লেখাপড়ার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে তোমরা সেটি টের পাওনি কারণ তোমাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকু পেয়েছে এদেশের চাষীদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে। আমি শুধু তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়ত তার নিজের সন্তানকে স্কুল-কলেজ শেষ করিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি, কিন্তু তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন তোমরাই ঠিক কর তোমরা এই শিক্ষাটুকু দিয়ে তুমি কার জন্য কি করবে! অবশ্য তুমি তোমার কর্মজীবন গোড়ে তুলবে, কিন্তু তার পাশাপাশি যাদের অর্থে তুমি লেখাপড়া করেছ সেই দরিদ্র মানুষের ঋণ তোমাদের শোধ করতে হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেনÑ ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ হারুন-উর-রশিদ আসকারী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ শাহিনুর রহমান এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন ট্রেজারার প্রফেসর ড. মোঃ সেলিম তোহা। এবারের সমাবর্তনে ১ হাজার ৬৩৭ জন ¯œাতক, ৭ হাজার ৪৮৮ জন ¯œাতকোত্তর, ১৩৭ জন এমফিল ও ১১০ জন পিএইচডি ডিগ্রীধারীদের মূল সনদ প্রদান করা হবে। সর্বমোট ৯ হাজার তিন শত ৭২ জনকে সনদ প্রদান করা হয়। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ৫ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় এবং সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০০২ সালের ২৮ মার্চ।। প্রায় ১৬ বছর পর ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে চতুর্থ সমাবর্তন। দুপুরের ভোজ শেষে মেধা তালিকার শীর্ষের ৮০ জন শিক্ষার্থীদের ‘রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয়। এক সঙ্গে আইন বিভাগের ৪ শিক্ষক পদক লাভ করেন। এরপর সকলে মেতে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়ার স্থানীয় শিল্পী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর দর্শকদের লালনের আধ্যাত্মিক গান শোনানর বাউল সাধক শফি ম-ল। একটু পরেই ভিন্ন স্বাদের গান নিয়ে মঞ্চে আসেন ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সানিয়া আক্তার লিজা এবং সবশেষে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী গান দিয়ে দর্শক মাতান এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘জলের গান।’ সমার্বতনে অংশ নেয়ার অনুভূতি জানিয়ে আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটা এখনও চোখের সামনে ভাসে। মনে হয় এই তো সেদিন ভর্তি হয়েছিলাম। অথচ লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরি করছি অনেকদিন। সমাবর্তনে যোগ দিতে এসে প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের মুহূর্তে হাজারো মধুর স্মৃতি এসে ভিড় জমাতে থাকে। তবে তখনও পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। হলের সামনে আসতেই পুরনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে মনে হলো এখনও সেই ফার্স্ট ইয়ারেই পড়ি। সারাদিন আড্ডায় মেতে ছিলাম। সমাবর্তনে জীবনের সব থেকে কাক্সিক্ষত ডিগ্রী পেয়ে আনন্দে চোখে জল এসে গেছে। সর্বশেষে রাত ১০টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সফল উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর রশিদ আসকারী, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সেলিম তোহাসহ প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ মঞ্চে আসেন। তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে সমাবর্তন সফল করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। উপাচার্য বলেন, ‘ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল, মুক্তমনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের বাতাবরণ আছে বিধায় আমরা আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে সকলের সহযোগিতায় সার্থক ও সাফল্যম-িত করতে পেরেছি। রাত গভীর হয়। অন্ধকারের মতোই যেন বিষাদ নামতে থাকে। বিদায়ের ক্ষণ বুঝি আসন্ন। রাতে কনসার্টের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন।
×