ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার;###;ট্রাইব্যুনালের ৩০তম রায়

মৌলভীবাজারের দুই রাজাকারের ফাঁসি, আমৃত্যু কারাদণ্ড ৩

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১১ জানুয়ারি ২০১৮

মৌলভীবাজারের দুই রাজাকারের ফাঁসি, আমৃত্যু কারাদণ্ড ৩

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৌলভীবাজারের রাজনগরের পাঁচ রাজাকারের মধ্যে নেছার আলী (৭৫) ও উজের আহমেদ চৌধুরীকে (৬৩) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। অপর তিন রাজাকার সামছুল হোসেন তরফদার ওরফে আশরাফ (৬৫), ইউনুছ আহমদ (৭১) ও মোবারক মিয়াকে (৬৬) আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এই রায় প্রদান করেছেন। এটি হলো আন্তর্জঅতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩০তম রায়। এর আগে আরও ২৯টি রায় প্রদান করা হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য প্রসিকিউটরগণ উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন বলেন এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট । অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী জানিয়েছে তারা এ রায়ে বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত আপীল করবে। প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন বলেন, ‘আসামিদের দ- দিয়ে ট্রাইব্যুনাল যে সাজা ঘোষণা করেছেন তাতে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। তবে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে সরকারকে অবহিত করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে একাধিক মামলা হয়। কিন্তু সেখানে আসামি ইউনুছ আহমদের নাম ছিল না। তবে ওই এলাকায় ইউনুছ নামে আরেক রাজাকার ছিল। এই মামলায় রাজনৈতিকভাবে সেই রাজাকার ইউনুছকে না এনে আমার মক্কেলকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে।’ আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করব। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, আদালত রায়ে দুটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এক হচ্ছে, যখন একাত্তরের ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ হচ্ছে তখন ১৯৭১ এর ইতিহাস মূর্তমান হয়ে ওঠে সমাজে সবার সামনে। তার মানে হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে অসমাপ্ত ইতিহাস তা এ বিচারের মাধ্যমে উঠে আসছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বৃদ্ধ বয়স দ- কমানোর ক্ষেত্রে কোন কারণ হতে পারে কি-না তার প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আজকে রায়ে ট্রাইব্যুনাল সুস্পষ্টভাবে বলেছে- বৃদ্ধ বয়স কখনও দ- কমানোর ক্ষেত্রে কোন কারণ হতে পারে না। একাত্তর সালে যে অপরাধ করেছে সে অপরাধ এতটাই ঘৃণ্য, এতটাই ভয়াবহ তার জন্য বৃদ্ধ বয়স কোন যৌক্তিক কারণ হতে পারে না, তাকে (আসামিকে) কম দ- দেবার জন্য। এ মামলায় ফাঁসির দ-প্রাপ্ত উজের আহমেদ চৌধুরীর বয়স ৬৩ এবং নেসার আলীর বয়স ৭৫ বছর। এ ছাড়া আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত ইউনুছ আহমদ এর বয়স ৭১ বছর, শামছুল হোসেনের বয়স ৬৫ এবং মোবারকের বয়স ৬৬ বছর। বুধবার সকাল ১১টায় ওই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে ২০২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি ইউনুছ আহমদ ও উজের আহমেদ চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। কাশিমপুর কারাগার থেকে সকালেই তাদের আদালতে আনা হয়। বাকি তিন আসামি পলাতক রয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়। এক নম্বর অভিযোগে পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদ-, দুই নম্বর অভিযোগে তিনজনের যাবজ্জীবন, তিন নম্বর অভিযোগে দুইজনের পাঁচ বছর করে কারাদ-, চার নম্বর অভিযোগে ৫ জনের আমৃত্যু কারাদ- , পাঁচ নম্বর অভিযোগে দুই জনের মৃত্যুদ- ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। এটি ট্রাইব্যুনালের ত্রিশ তম রায় ॥ মৌলভীবাজারের পাঁচ রাজাকারের রায়টি ৩০তম রায়। এর আগে ট্রাইব্যুনাল আরও ২৯টি রায় প্রদান করেছেন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি নিয়ে মোট ৩০টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এই সমস্ত মামলায় ৬৬জন আসামি ছিলেন। দ- দেয়া হয়েছে ৬৪জনকে। দুইজন আসামি সোলায়মান মোল্লা ও আব্দুল লতিফ রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। এই ৬৪জনের মধ্যে ৩৮জনকে মৃত্যুদ-, ২৩জনকে আমৃত্যুকারাদ-, একজনকে যাবজ্জীবন করাদ- প্রদান ও একজনকে ৯০ বছরের দ- প্রদান করা হয়। দ-প্রাপ্ত ও তদন্তাধীন মোট ৮৪জন আসামি পলাতক রয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও ৩৩টি মামলায় ১৩৯জন রাজাকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ॥ মৌলভী বাজারের পাঁচ রাজাকারের রিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে (১) একাত্তরের ২২ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার বালিগাঁও গ্রামের শহীদ দানু মিয়ার বাড়ি, ছমেদ উল্লার বাড়ি, তাজু মিয়ার বাড়ি এবং মৌলভীবাজার মহকুমা শহরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, অন্যায় আটক, নির্যাতনসহ শহীদ দানু মিয়াকে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এক নম্বর অভিযোগে সব আসামিকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। (২) ২নং অভিযোগে আসামি নেছার, ইউনুছ, উজেরের বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৩ নবেম্বর রাতে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানাধীন নন্দিউড়া গ্রামের হরেন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ি, রাজনগর থানা এবং মৌলভীবাজার মহকুমা শহরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অন্যায়ভাবে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। দুই নম্বর অভিযোগে সবার আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। (৩) ৩নং অভিযোগে আসামি নেছার আলী, ইউনুছ আহমদ এবং উজের আহমেদের বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানাধীন রাজাপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের বাড়ি, উত্তরভাগ গ্রামের ইন্দেশ্বর দাতব্য চিকিৎসালয়ের আবাসিক ভবন এবং মৌলভীবাজার মহকুমা শহরে লুণ্ঠন, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ডাক্তার যামিনীমোহন দেবকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তিন নম্বর অভিযোগ ইউনুছকে খালাস ও বাকি দুইজনের পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। (৪) ৪নং অভিযোগে আসামি সামসুল, নেছার, ইউনুছ আহমদ উজের, মোবারকের আহমেদের বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের রাজনগর থানাধীন উত্তরভাগ গ্রামের ডাক্তার রসরাজ ভট্টাচার্যের বাড়িতে লুণ্ঠন, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। চার নম্বর অভিযোগে সবার আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। (৫) ৫নং অভিযোগে উক্ত পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৯ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানাধীন দক্ষিণ খলাগ্রাম (নরাটিলা) সেকান্দার আলী, শহীদ আব্দুল বাছিত ওরফে বাদশার বাড়ি, রাজনগর থানা এবং মৌলভীবাজার মহকুমা শহরে লুণ্ঠন, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ন্যাপ নেতা মোঃ নজাবত আলীকে সহ ১৪জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পাঁচ নম্বর অভিযোগে নেছার, উজেরের মৃত্যুদ- ও বাকি তিনজনকে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে।
×