ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন ভাবনায় নতুন বছর

প্রকাশিত: ০৭:১২, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

নতুন ভাবনায় নতুন  বছর

শাকিল আহমেদ॥ দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে শেষ হলো বছর। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে শেষ হলো আরও একটি খ্রিস্টীয় বছর। সকালের সূর্যটা নতুন না হলেও ক্ষণটি একেবারেই নতুন। নতুন বছরের শুরুতেই তাই সবাইকে শুভেচ্ছা, সেই সাথে থাকছে মন, মনের সুস্থতা এবং এই সম্পর্কিত কিছু কথা, বইয়ের কচকচানি নয়। একজন মানুষ বাঁচে নিজের জন্য, তার পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই যথার্থ ভূমিকা পালনের জন্য দরকার সুস্থ দেহ, সুস্থ মন। (প্রকৃতপক্ষে দেহ এবং মন আলাদা কিছু নয়, তবু বোঝার সুবিধার্থে আলাদাভাবেই ধরে নিচ্ছি)। দেহের সুস্থতার জন্য যেমন অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয় বা চলা উচিত, মানসিক সুস্থতার জন্য তেমনই বেশ কিছু নিয়ম মানতে হয়, মানা উচিত। এসবের অনেক কিছুই এত ছোটখাটো ব্যাপার যে, আমরা আলাদাভাবে তাদের অস্তিত্বই হয়তো বুঝি না। অথচ, এসবই জন্ম দিতে পারে যন্ত্রণার এক বিরাট মহীরুহের– যার ফলে নষ্ট হয় একটি জীবন এবং তার উপর নির্ভরশীল সবকিছুই। নতুন বছরের শুরুতেই তাই জেনে নেয়া যাক অল্প কিছু কথা- কি কি আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত, কি কি পরিবর্তন করা উচিত, পরিবর্তন করলে কি সুবিধা ইত্যাদি । ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই দিনের বেশিরভাগ সময় নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় কাটাই। যার যার অবস্থানে যার যার মতো। কিন্তু, এসব দুশ্চিন্তা প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হতে হতে এক সময় অনিয়ন্ত্রিত, অযৌক্তিক এবং সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিন, নতুন বছরে আর অহেতুক, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবেন না। ফলে, কমে যাবে উদ্বিগ্নতা জনিত মানসিক এবং শারীরিক রোগ হওয়ার ভবিষ্যত সম্ভাবনা। বিগত বছরে কিংবা জীবনের বিগত সময়ে আপনার অর্জন সন্তোষজনক না হতে পারে, কিংবা প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারে, অথবা অনেক সমস্যার জালে আটকে গেছেন এমনও হতে পারে। দুঃখ হতেই পারে, ভাল না লাগতেই পারে। কিন্তু ভেঙে পড়া যাবে না, হতাশাগ্রস্ত হওয়া যাবে না। যদি এতে সফল হতে পারেন, তবে এড়ানো যাবে বিষণœতা জনিত সমস্যা, নেশা জাতীয় সমস্যাসহ আরও অনেক জটিল মানসিক রোগ। আপনার থাকতে পারে দীর্ঘদিনের সামাজিক মেলামেশায় অস্বস্তি, কিংবা নিজের মতো করে একা থাকার প্রবণতা। এখনি তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করুন, না হলে ভবিষ্যতে এটাই হতে পারে সিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগের পূর্ব নিয়ামক। হয়ত আপনার ব্যক্তিত্বে বা আচরণে রয়েছে কিছু অস্বাভাবিকতা, যেমন- খুঁতখুঁতে মনোভাব, অপরের ক্ষতি করার প্রবণতা, অতিরিক্ত আত্ম-অহঙ্কার, সন্দেহ বাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। খুঁজে বের করুন আর আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন। মানসিক রোগ তো ঠেকাবেই, তার চেয়ে বিশাল ব্যাপার হলো সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় থাকবে, জীবন আরও মধুর হবে, ব্যক্তিত্ত্ব হবে সর্বাঙ্গীন সুন্দর। এটাও তো অনেক বড় পাওয়া। চিন্তা-ভাবনার এক বিশাল প্রভাব রয়েছে জীবনে। যেমন- যৌনতা নিয়ে একজন মানুষের অতিরিক্ত চিন্তা বা বিকৃত চিন্তা বা ভুল ধারণা জন্ম দিতে পারে বিকৃত যৌনরুচির, হতে পারে বিভিন্ন যৌন অশান্তির কারণ। তাই, ত্যাগ করুন নানা ধরনের আজে বাজে চিন্তা-কুচিন্তা করার অভ্যাস, সেই সঙ্গে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব, গোঁয়ার্তুমি, বদ-মেজাজ এসবও। আপনার সুন্দর মন সবার কাছে আপনাকে প্রিয় করে তুলবে- শারীরিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে, আপনার অন্য সব ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে। পারিবারিক ক্ষেত্রে হয়ত আপনি একজন বাবা কিংবা মা। সন্তানকে খুব ভালবাসেন, সারাক্ষণ কিসে তার ভাল হয় এমন চিন্তাতেই কাটান। তবে খেয়াল রাখুন, আপনার এই আপাত নিরীহ চিন্তা তার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠছে কিনা, আপনার এই অতিরিক্ত সতর্কতা তার আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে পরনির্ভরশীল করে তুলছে কিনা। আপনার প্রত্যাশা তার পিঠের বইয়ের ব্যাগের ওজনের চেয়েও বেশি ভারি হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা, আপনার আরোপিত বিধিনিষেধ তাকে ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী করে তুলছে কিনা, আপনার অতি-বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বা উপহাস তার কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে কিনা। অথবা আপনি একজন উদাসিন অভিভাবক, সন্তানের কোন কিছুতেই আপনার খেয়াল নেই, টাকা দিচ্ছেন যখন যা লাগে এবং সেটাকেই সরর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন ভেবে সন্তুষ্ট। সন্তানের আবেগ-অনুভূতি, সাফল্যের আনন্দ, ব্যর্থতার কষ্ট কোন কিছুতেই আপনি ভাগ বসান না, নিজের কর্মব্যস্ততায় অসম্ভব ব্যস্ত। উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনুন, সব কিছুতেই পরিমিতি বোধ বজায় রাখুন। আপনার এই পরিবর্তন আপনার সন্তানকে রক্ষা করবে অপরাধ প্রবণতা, নেশা করার প্রবণতা, হতাশা-বিষণœতা, আত্মহত্যাপ্রবণতাসহ অনেক সমস্যার হাত থেকে। বৃদ্ধি করবে তার আত্মবিশ্বাস ও কর্মদক্ষতা। নির্মিত হবে তার সোনালি ভবিষ্যত এবং সেই সঙ্গে আপনার সুখী জীবন। একই কথা আপনার জীবনসঙ্গী এবং পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মনে রাখুন, পরিবারের কাউকে বেশি সময় দেয়া বা অতিরিক্ত তদারকি করা বা একেবারে উদাসিন থাকা কোনটাই পারিবারিক শান্তি-সুখ-সমৃদ্ধি বয়ে আনে না। যেটা কাজে আসে তা হলো- কিছু সময় পরস্পরের অনুভূতি ভাগাভাগি করা, মতামত বিনিময় করা। ইংরেজীতে যাকে বলে ‘ছঁধষরঃু ঞরসব’। খেয়াল করুন আপনি তার কতটুকু পূরণ করছেন, যদি কোন ঘাটতি থেকে থাকে, এই বছর থেকেই তা পূরণ করা শুরু হোক। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা সমগ্র মানব জাতির ক্ষেত্রে অবদান রাখবে আপনার এসব পরিবর্তন। আলাদাভাবে অন্য কোনকিছু যদি করতে নাও পারেন, চাইলেই তা পারেন, অন্যদের মাঝে এই ধ্যান-ধারণাগুলো প্রচার করতে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলতে, হতাশাগ্রস্ত কাউকে সাহস দিতে-এ রকম আরও অনেক কিছুই। জীবন আসলেই সুন্দর একটা ব্যাপার। এই বেঁচে থাকা, এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করা, সুখে হাসা-দুঃখে কাঁদা- এ এক বিরাট অভিজ্ঞতা, অনির্বচনীয় অনুভূতি। খুব অল্প সময়ব্যাপী হওয়াটা-জীবনের মূল সৌন্দর্য আবার প্রধান অসুবিধা। অসুবিধা তখনই- যদি এই অল্প সময়টা সঠিকভাবে ব্যয় না করি, ছোটখাটো ব্যাপার উপেক্ষা করে বিশাল সমস্যার তৈরি করি। আর এর বিপরীতটাতেই সৌন্দর্য।
×