ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

ডিসনির মেলব্যাগ ॥ মুক্ত জিম্বাবুইয়ে ফিরে দেখা ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৭ জানুয়ারি ২০১৮

ডিসনির মেলব্যাগ ॥ মুক্ত জিম্বাবুইয়ে ফিরে দেখা ইতিহাস

যারা অকারণে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করে তাদের জন্য এই লেখাটি। ভাল করে জানুন কোন দেশের কোন নায়কের কি ইমেজ। অনেকদিন গদিতে থেকে পাগল নেতাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন কোথায় অনন্য শেখ হাসিনা। কেন তিনি আজ অপরাজেয়? এই নববর্ষে তিনিই আমাদের সেরা উপহার। অবশেষে মুগাবে মুক্ত হলো জিম্বাবুইয়ে। সাউথ আফ্রিকায় অবস্থিত এই দেশের একদা নাম ছিল রোডেশিয়া। আমাদের জানা দরকার একদা ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত এই দেশে শ্বেতাঙ্গরা গিয়েছিল মাইনিং আর কৃষি কাজে উপার্জনের আশায়। সে জিম্বাবুইয়েতে এখন মুদ্রাস্ফীতির হার ২৩১ শতাংশ। শ্রুত যে, এক বোতল কোমল পানীয় কিনতেও এক মিলিয়ন মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে সেখানে। আমি যখন অষ্ট্রেলিয়া আসি এবং আস্তে আস্তে এদেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে নানা পদে কাজ করতে শুরু করি দেখলাম প্রচুর অজির ফার্ম আছে সেখানে। যেগুলো নানা কারণে চললেও আসলে মৃতপ্রায়। শুরুতেই বলি, জিম্বাবুইয়ে এমন একটি দেশ যার জনগোষ্ঠী সুযোগ পেলেই আবার তাকে শীর্ষে নিয়ে যাবে। ফলে আমরা যেন কোন কারণেই আমাদের সঙ্গে তুলনা না করি। একজন মানুষের দেশ শাসনেরও একটা সীমারেখা থাকে। আমাদের দেশে আমরা একনায়কদের নয় বছরের বেশি সময় দেইনি। উন্নয়নের একদশক বলে বই পুস্তক লিখে বাস্তবকদের দ্বারা কাহিনী বানিয়ে রাজা রানী বনে যাবার আগেই বিদায় করে দিয়েছি আমরা। উত্তর কোরিয়া কিংবা জিম্বাবুইয়ের মতো দেশগুলো তা পারেনি। এদেশের বেলায় ধারণা করি একটা বড় কারণ ছিল মুগাবের স্বাদেশিকতা অথবা স্বদেশবোধ। তাঁর একটা প্রচলিত কথা ছিল, মৃত ব্যতীত কোন সাদা লোককেই বিশ্বাস করা যায় না। এই ধরনের উগ্র কথায় উগ্র জাতীয়তাবাদে কোন দেশের মুক্তি বা ভৌগোলিক স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হলেও তার ভবিষ্যত নিশ্চিত হয় না। তাছাড়া যে পর্যন্ত বিরোধিতার দরকার সেটা শেষ হবার পর অকারণ বৈরিতা একসময় নিজেকেই নিজের দুশমনে পরিণত করে। রবার্ট মুগাবের বেলায়ও তাই হয়েছে। সুযোগ ছিল গান্ধী কিংবা ম্যান্ডেলার মতো সরে দাঁড়ানোর। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ লেখা যখন লিখছি তখন বলা হয়েছে, চাইলে তাঁকে দেশত্যাগের অনুমতিও দেয়া হবে। সেটা যদি হয়তো দেখার বিষয় কোন দেশে যান তিনি। এতদিন ধরে গালাগাল দিয়ে আসা শ্বেতাঙ্গদের দেশছাড়া বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য কোথায় যাবেন সেটাই বুঝতে চাচ্ছি। জনাব মুগাবে তাঁর শাসনামলে এমন এক দেশ বানিয়েছিলেন যেখানে মুখ খোলা ছিল বিপজ্জনক। সাদাদের বিরোধিতা করা এই দেশের ইতিহাসে আছে ৮টি অলিম্পিক স্বর্ণপদক। যার একটি হকিতে আর বাকি সাতটি এনে দিয়েছেন সাদা সাঁতারু রমণী কৃষ্টি কভেন্ট্রি। আমরা তাদের চিনি ক্রিকেট খেলায়। জিম্বাবুইয়ে এমন এক ক্রিকেট টিম যার নেতৃত্ব থেকে দলের খেলোয়াড়দের বেশির ভাগই সাদা চামড়ার। এই যে বৈপরীত্য এটাই আমাদের বুঝতে হবে। মুগাবে মুখে সাদাদের বিরোধিতা আর অর্থনীতিতে দুয়ার খুলতে না পারলেও এগুলো মেনে নিয়েছিলেন তার নিজের স্বার্থে। তাছাড়া কে কোথায় জন্মাবে আর কে কোন দেশের সেটা কোন সরকার প্রধান নিয়ন্ত্রণ করেন না। ফলে তাদের এখতিয়ার নেই কাউকে ঠেকানোর। আমাদের দেশেও আমরা ইদানীং কৌশলে সংখ্যালঘুদের তাড়ানো ও তাদের ওপর নির্যাতনের ভেতর দিয়ে আতঙ্ক তৈরি হতে দেখছি। মুগাবের আমলে ৩৭ বছরে তেমন অনেক ঘটনাই আছে যা দেশটিকে ভালভাবে এগুতে দেয়নি। মুগাবের মতো নেতাদের সমস্যা তারা স্বাধীনতা বোঝেন বা তার জন্য লড়াই করেন বটে এটা মানেন না কোন বৈরিতাকেই আজীবন লালন করতে নেই। বিশেষত দেশ ও জাতির স্বার্থে চিরবন্ধু বা চিরদুশমন বলে কিছু থাকে না। যদি না সে দেশ পাকিস্তানের মতো আমাদের পিছে লেগে নাথাকে। জিম্বাবুইয়ের জীবনযাপন ও সেখানকার বদলে যাওয়া সমাজের ছবি মুগাবে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন অভাবতাড়িত মানুষ পেট মোটা ভুড়িওয়ালা লোক দেখলেই বুঝতো ইনি সচ্ছল। এবং এর পেটে নিয়মিত খাবার জোটে। অথচ এই দেশ এখন লেখাপড়ার হারে এগিয়ে। আফ্রিকায় তাদের শিক্ষার হার ৯০ শতাংশ। কিন্তু মানুষের গড় আয়ু সেখানে মাত্র ৪৫ থেকে ৪৬। জিম্বাবুইয়ের ভা-ারে আছে সোনা, স্টিল, কয়লা, কাপড়, সিগারেট আরও অনেককিছু। মাথা তুলে দাঁড়ানো তাদের সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই যে ৯৩ বছরের একজন মানুষ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ শাসনের নামে তার রাজত্ব চালিয়ে গেলেন সেখান থেকে কি কোন কিছু শিখব না আমরা? ইতিহাস বলছে আসার চাইতে সুন্দরভাবে যাবার বিষয়টাই মানুষের পরিণতি। আর এই পরিণতি যদি শুভ না হয় তো তার অর্জন বিসর্জন কোনটাই কাজে লাগে না। আমাদের উপমহাদেশে জোর করে বিদায় না দেয়া অবধি কেউ যেতে চায় না। মুগাবেও চাননি। তবে আমাদের সঙ্গে তফাৎ এই, সেদেশের সেনাবাহিনী অকৃতজ্ঞ না। তারা তাদের দেশের জনককে মারেনি। হত্যা করেনি। যা কিছু হয়েছে সব আলাপ-আলোচনায়। দলের ভেতর তাঁকে কোণঠাসা করার বিষয়টা ভারত ছাড়া আমাদের কোন প্রতিবেশী দেশে সম্ভব? কার ঘাড়ে কটা মাথা যে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে কথা বলে? পিছিয়ে পড়া জিম্বাবুইয়ের সঙ্গে এটা আমাদের পার্থক্য। ৩৭ বছর একজন মানুষকে দেবতা বানানোর পর ও তারা বা দল বিরুদ্ধে যাবার সুযোগ পায় এবং তা কার্যকর করতে পারে। জিম্বাবুইয়ের লোকজনের একটা মজার কথা বলি, তারা যে কোন পানীয় কে বলে কোক, যে কোন ওয়াশিং পাউডারকে ডাকে সার্ফ, যে কোন টুথপেস্টকে বলে কোলগেট আর মেঝে সাফ করার উপাদানকে বলে কোবরা। এক নায়ক এক রাজা এক মানুষ দেখতে দেখতেই হয়তো এমন হাস্যকর পরিণতি। সবকিছুকে একনামে ডাকার এই কালচার থেকে মুক্ত জিম্বাবুইয়ের নতুন নেতা যিনি হবেন তাঁকে বলা হয় কুমির। দেখা যাক, এবার তাঁরা এই কঠিন নামে পরিচিত মানুষটিকে এনে কি খাল কেটে নতুন কুমির আনলেন না তিনি হয়ে উঠবেন মুক্তিদাতা? আমাদের দেশের রাজনীতি বড় অদ্ভুত। যেদেশের সঙ্গে লড়াই করে জান দিয়ে ইজ্জত হারিয়ে যার বিরোধিতার মুখে ছাই দিয়ে আমরা মুক্ত হলাম সে পাকিস্তান যাবার বেলায় নিষেধ না থাকলেও একদা রোডেশিয়া যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল আমাদের পাসপোর্টে। পরে খুলে যাওয়া এই দেশের সঙ্গে ক্রিকেটের নানা কারণে একটা সম্পর্ক তো আছেই। আশা করি সেটা গভীর হবে আরও। রবার্ট মুগাবের যাওয়া আবারও প্রমাণ করল জোর করে থাকা যায় বটে তবে তার প্রস্থান হয় নিন্দনীয়। আর সে যাওয়া হয় অপমানের। মুগাবে গর্ব করে বলতেন র‌্যাসিজম ততদিন থাকবে যতদিন সাদা গাড়িতে কালো চাকা বা মরণে কালো কাপড় বিবাহে সাদা পোশাক যতদিন মানুষ সাদাকে শুভ কালোকে অন্ধকার মানবে। বলতেন তিনি খুশী তার কালো পশ্চাৎদেশ তিনি সাফ করেন সাদা টয়লেট পেপারে। আজ মনে করিয়ে দিতে হবে আপনার বিদায় কে কি বলবেন হে একনায়ক? সাদার যাওয়া না কালোর বিদায়? [email protected]
×