ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২ মে ২০২৪; আপডেট: ১৯:৪৩, ৩ মে ২০২৪

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

চর্যাপদের গান নিয়ে ৫০০ আসর আয়োজনের মাইলফলক স্পর্শ করেছে ‘ভাবনগর সাধুসংঘ’।

লালনের গান নিয়ে যে কাণ্ডটা হলো, আগে সে সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। হ্যাঁ, মহান সাধক লালন ফকিরের গান থেকে দুটি চরণ ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন এক ভক্ত।  ‘লালন বলে জাতের কি রূপ/দেখলাম না এই নজরে।/সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কি হয় বিধান।/বামণ চিনি  পৈতে প্রমাণ/বামণী চিনি কি করে...।’

হ্যাঁ, বিখ্যাত এই গানের দুটি চরণ ফেসবুকের স্টোরিতে তুলে ধরেছিলেন শরীতপুরের সঞ্জয় রক্ষিত। তাতেই চিরচেনা চিহ্নিত মূর্খ মৌলবাদী গোষ্ঠীর ‘অনুভূতি’ যারপরনাই খাড়া হয়ে যায়। থানার দারগা বাবুটি ছিলেন খাসা। মিন্টু মন্ডল নাম।

ডান্ডা মেরে উগ্র অনুভূতিওয়ালাদের তিনি ঠান্ডা করতে যাননি। উল্টো লালন ভক্তকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিয়েছেন! কেউ কেউ তো বলছেন, ভাগ্যিস লালন আর বেঁচে নেই। থাকলে হয়ত সবার আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কোনো একটা মেডেল অর্জনের পথ সুগম করতে পারতেন থানার তীব্র দায়িত্ববান ওই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব কারণে কখনো লালনের, কখনো রবীন্দ্রনাথের মু-ুপাত করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত বিভ্রান্ত সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।

অথচ রাষ্ট্র নীরব। রাষ্ট্র রাষ্ট্রের মৌল নীতি আদর্শগুলো যেন ভুলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, দুঃখ হয় আমাদের। কষ্ট হয়। তবে তার চেয়েও বেশি জরুরি প্রতিবাদ। ধর্মান্ধ পরমত অসহিষ্ণু জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা জারি রাখতে হবে। এরই মাঝে রাজধানী ঢাকায় নানা প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে। হচ্ছে। এই প্রতিবাদ আরও জোরালো হোক। ছড়িয়ে যাক গোটা দেশেÑ আমাদের তা-ই প্রত্যাশা।     

চর্যাপদের গানের ৫০০ আসর ॥ চর্যাপদের গান, বলা চলে, হারিয়ে গিয়েছিল। অমূল্য সেই রত্নগর্ভার কথা ভুলে গিয়েছিলেন অনেকে। তবে আশার কথা যে, এক দল সাধক শিল্পী গবেষক প্রাচীন গানগুলোকে নতুন করে খুঁজে নিয়েছিলেন। পরম যত্নের সঙ্গে গাওয়া শুরু করেছিলেন। মূল উদ্যোক্তা ড. সাইমন জাকারিয়া। গবেষণাসহ অন্যান্য কাজ তিনি করছিলেন। গাইছিলেন সাধিকা সৃজনী তানিয়ার মতো নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীরা।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিতভাবে চর্যাপদের গানের আসর আয়োজন করা হচ্ছিল। কেউ এই আসরের কথা জানতেন। কেউ জানতেন না। কিন্তু নীরবে এগিয়ে চলছিল চর্চা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার ৫০০ আসর আয়োজনের মাইলফলক স্পর্শ করে ভাবনগর সাধুসঙ্গ। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে! তেমন কোনো প্রচার নেই। টেলিভিশন বা পত্রিকার খবরে নেই। কিন্তু প্রাণের তাগিদেই অব্যাহত ছিল চর্চা। এমন আন্তরিক প্রয়াস সত্যি বিরল। ৫০০তম আসরটির কথা বলি।

বরাবরের মতোই উন্মুক্ত আকাশের নিচে গোল হয়ে বসেছিলেন সাধক শিল্পীরা। আয়োজনের শুরুতে ছিল দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে চর্যাপদের সুর, শঙ্খ বাদন। এর পর সমবেত কণ্ঠে ভাবনগর সাধুসঙ্গের সাধক শিল্পীরা চর্যাপদের প্রথম পদ পরিবেশন করেন। ভাবনগর সাধুসঙ্গ নিয়ে স্বরচিত একটি পরিবেশনা ছিল সাধক কবি ইউসুফ মিয়ার কণ্ঠে। অন্যদের মধ্যে গান করেন চর্যাপদের গানের অত্যন্ত প্রশংসিত কণ্ঠ সাধিকা সৃজনী তানিয়া। শাহ আলম  দেওয়ান, শিলা মল্লিক এবং অন্তর সরকারের পরিবেশনাও মুগ্ধ করে শ্রোতাদের।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাপানের গবেষক-অধ্যাপক ড. মাসাহিকো তোগাওয়া, বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পরসিক ওরিয়েন্টাল স্টাডি গ্রুপের কিউরেটর মিখাইল আই ইসলাম, অধ্যাপক ড. মলয় বালা প্রমুখ। প্রধান অতিথির ভাষণে ড. মাসাহিকো তোগাওয় বলেন, আমি নিজেও একজন ভাবসাধক। তাই যখনই ঢাকাই আসি তখনই আমি ভাবনগর সাধুসঙ্গে আসি। এখানে একটি মহৎ কাজ হচ্ছে। আজ এই সাধুসঙ্গের ৫০০তম আসর হচ্ছে। এটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। ভাবনগর সাধুসঙ্গের এই ঐতিহ্য ভবিষ্যতে চলমান থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এর আগে সূচান বক্তব্যে ড. সাইমন জাকারিয়া ভাবনগর সাধুসঙ্গের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের জ্ঞান সাধনার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করেন। অন্যান্য বিষয়ে কথা বলেন ভাবনগর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নূরুননবী শান্ত, ড. মলয় বালা ও সাইদ হাফিজ। এ সময় শিল্পী অমিত নন্দী, সূফিসাধক নজরুল ইশতিয়াক, গবেষক গৌতম চন্দ্র বর্মণ, জাহাঙ্গীর আলম, নাজমূল হোসেন, হাসান দবির উদ্দিন, বাবুল আক্তার, মো. মারফত আলী, ফারুক সরকারসহ অনেক ভক্ত-অনুরাগীরা উপস্থিত ছিলেন।

আসর থেকে আগামী ৮ থেকে ১০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যৌথভাবে ‘চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪’ আয়োজনের ঘোষণা দেন ড. সাইমন জাকারিয়া। চর্যাপদের গানের এই নবযাত্রা অব্যাহত থাকুক। এগিয়ে যাক- আমাদের পক্ষ থেকে শুভ কামনা থাকল।

×