ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সেই কদর নেই ল্যান্ডফোনের

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

সেই কদর নেই ল্যান্ডফোনের

সেই কদর আর নেই...। নব্বইয়ের দশকের শেষের আগেও কি যে কদর! ভরা যৌবন। কোন বাড়ির ড্রইংরুমে বা বেড রুমে থাকলে প্রেস্টিজ কয়েক ধাপ এগিয়ে। এক বাড়ির এক যন্ত্র দশ বাড়ি, কখনও পাড়া পড়শির খবরও বয়ে আনে। এই যন্ত্রেই কত না কথা...। যন্ত্রটির নাম টেলিফোন। সেল ফোনের (মোবাইল ফোন) যুগে এর পরিচয় ল্যান্ড ফোন বা ফিক্সড ফোন। সত্তরের দশকের জনপ্রিয় একটি গান- ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পাঠাইতাম...’ গানটি অনেক কণ্ঠশিল্পী গেয়েছেন। রচয়িতা প্রিয়ার বিরহী মনের ভাবনা তুলে এনেছিলেন। তার সুদূরপ্রসারী ভাবনা একবিংশ শতকে প্রায় বাস্তবে রূপ নিয়েছে। টরেটক্কার টেলিগ্রাম সেই কবেই বিদায় নিয়েছে। প্রজন্ম টেলিগ্রামের বর্ণনা শুনে হাসে। সমাজ জীবনের চিঠি লিখার দিনগুলো হারিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগেও ল্যান্ড বা ফিক্সড টেলিফোনের কী না কদর। এখন সেই কদর হারিয়েছে। কোন টেলিফোন সচল রাখতে টেকনিশিয়ানরা কাঁধে মই, ঝুলিতে টেলিফোন সেট নিয়ে শহরের বাসা বাড়িতে যায়। কি পরিবর্তন। নিকট অতীতে শহরের পাড়া মহল্লায় কোন বাড়িতে টেলিফোন থাকলে বাড়ির কর্তা ও সদস্য পড়শীর সামাজিক যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করতেন। বাইরে থেকে ফোনে আসা আনন্দ, বেদনার খবর, উৎকণ্ঠা জাগানো ও কমানোর খবর আসতো ওই এক টেলিফোনে। পরশীদের ডেকে দিতে হতো। তৎকালীন টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ (টিএ্যান্ডটি) বোর্ড বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেসন্স লিমিটেড (বিটিসিএল) অফিসে গিয়ে বাড়িতে একটি টেলিফোন সংযোগের জন্য কতই না ধর্ণা দিতে হতো। ফি জমা দিতে হতো ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। ঘরে টেলিফোন প্রাপ্তি ছিল সোনার হরিণ। সেদিনের টেলিফোনে কথা বলতে দূরত্ব ভেদে প্রতি মিনিটের জন্য গুনতে হতো ২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা। সত্তরের দশকের প্রথমেও এক জেলা থেকে আরেক জেলায় কথা বলার পদ্ধতি ছিল ট্রাঙ্ক কল। সকালে কল বুক করলে কখনও রাতেও সংযোগ মিলত। বৈদেশিক কলের জন্য পাবলিক কল অফিসে (পিসিও) গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। গুনতে হতো কয়েকশ’ টাকা। আশির দশকের মধ্যভাগে নেশনওয়াইড ডায়ালিং (এনডব্লিউডি) প্রযুক্তি চালু হলে ট্রাঙ্ককলের যুগ শেষ হয়। এনডব্লিউডি হলো প্রতিটি জেলার একটি নির্দিষ্ট কোড নম্বর মূল নম্বরের আগে বসিয়ে সরাসরি ডায়াল করে সংযোগ পাওয়া। সেই কোড এখনও আছে শুধু প্রযুক্তির পালাবদল ঘটেছে। আজ সেই টেলিফোনের কি বেহাল দশা। পারত পক্ষে কেউ বাড়ির ল্যান্ড টেলিফোনে কথা বলতে চায় না। এখন স্মার্ট এ্যান্ডরয়েড ও আই ফোনে দেশে বিদেশে ভয়েস কলের পাশাপাশি ভিডিও কলে লাইভ কথা বলা যায়। ইন্টারনেট, কম্পিউটারেরও কাজ করে সেলুুলার এই ফোন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক টুইটার ছাড়াও ইউটিউব বায়োস্কোপে কত কি দেখা যায়। আর ল্যান্ড ফোনে শুধু ভয়েস কল। শহর নগর মহানগরের অনেকের বাড়ির ল্যান্ড টেলিফোন সারেন্ডার করা হয়েছে। এই বিষয়ে বগুড়ার কয়েকজন প্রাক্তন গ্রাহক বললেন, এখন বাড়ির সকল সদস্যের হাতে স্মার্ট সেল ফোন। ল্যান্ড টেলিফোন রাখাই বাড়তি খরচ। প্রতি মাসে সেট ভাড়া দিতে হয় ১২০ টাকা। তার সঙ্গে যোগ ভ্যাট। ভিন্ন মত পোষণ করলেন কয়েকজন। তাদের কথা- ল্যান্ড ফোনে যত স্বচ্ছন্দে বলা যায় সেল ফোনে তা হয় না। সেল ফোনে অনেক কথা বোঝাও যায় না। সেল ফোনে কথা বলার সময় যে রেডিয়েশন আসে তা ক্ষতিকর। এই ক্ষেত্রে ল্যান্ড ফোন কথা বলা স্বাস্থ্যসম্মত। বিটিসিএলের অফিসগুলোতে এখন কালে ভদ্রে স্থানীয় টেলিফোন অফিসে লোকাল ইনকোয়ারি ১৭ ও লোকাল কমপ্লেইন ১৮ এ ফোন করা হয়। প্রকৌশলীগণের কাজ শুধু মেইনটেনেন্স। এক সূত্রে জানা গেল, বিটিসিএলের রাজস্ব কমেছে। কল রেট কমানোর পরও আউট গোয়িং কলের সংখ্যা বাড়ছে না। সরকারী ও আধা সরকারী অফিসগুলোতে ল্যান্ড টেলিফোনের যে টুকু ব্যবহার তাই হয়। তবে কখনও সরকারী প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তিগত ফোন বেশি হয়। ওইসব ল্যান্ড ফোন থেকে কল বেশি যায় মোবাইল ফোনে। এদিকে বিটিসিএলের সেল ফোন (মোবাইল ফোন) কিছুটা লাভজনক পর্যায়ে গেলেও গ্রাহক সংখ্যা এখনও কম। তবে সরকারী বিভিন্ন কাজে বিটিসিএলের সেল ফোন ইটারনেট সংযোগে ব্যবহার হচ্ছে। এক কর্মকর্তা বললেন, বিটিসিএলের ল্যান্ড টেলিফোন আধুনিকায়ন না হলে এর অগ্রগতি থমকে যাবে। একজন গ্রাহক বললেন- ল্যান্ড ফোনের সঙ্গে ডিভাইসে চিপস, মেমোরি কার্ড, নির্দিষ্ট দূরত্বে ওয়্যারলেস সার্ভিস সুবিধাসহ অনেক প্রোগ্রাম দেয়া যেতে পারে। যে ভাবেই হোক গ্রাহকের চাহিদার কিছু সুবিধা তো থাকতে হবে। তা না হলে গ্রাহক কেন শুধুই কথা বলার জন্য ফিক্সড ফোন রাখবে, যখন সেলুলার স্মার্ট ফোনে নানাবিধ সুবিধা থাকছে। নিকট ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, হয়তো ফিক্সড ফোনকেও টেলিগ্রামের মতো জাদুঘরে যেতে হবে। সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×