ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চক্রের প্রধান রকিবুল ইসলাম ইসামীসহ গ্রেফতার ১২

ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জামায়াতী চক্র জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জামায়াতী চক্র জড়িত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জামায়াতী চক্র জড়িত। চক্রের প্রধান রংপুর জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তাসহ ১২ জন গ্রেফতার হয়েছে। চক্রের অন্যতম হোতা বিকেএসপির একজন সহকারী পরিচালককে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাত জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চক্রটির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে কত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফঁাঁসের মূল উৎপাটন করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। জামায়াতী চক্রটি সরকারকে পরিকল্পিতভাবে বিপাকে ফেলতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে পড়ে কিনা সে বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, গত ১১ ডিসেম্বর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলমান অভিযানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, চক্রের প্রধান রকিবুল ইসলাম ইসামী, সাইফুল ইসলাম, তার বিয়াই প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, তনয়, আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্র নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, বায়েজিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভির আহম্মেদ মল্লিক, প্রসেনজিৎ দাশ ও আজিজুল হাকিম। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হলো। এই সিআইডি কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্য, মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা ইউনিট আছে। আর সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিট রয়েছে। এই ইউনিটে সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে। ২০১৫ সালে প্রথম ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার অনুমতি পায় পিপলস প্রিন্টিং প্রেস। ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত প্রিন্টিং কারখানায় কর্মরত ছিল খান বাহাদুর (২৮)। বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জে। প্রেসটিতে খান বাহাদুর প্রায় দশ বছর ধরে কর্মরত। প্রেসেই রাত্রি যাপন করত। তার কাছে রাতে থাকত তারই বিয়াই সাইফুল ইসলাম। তার বাড়িও জামালপুরের মেলান্দহে। প্রেস মালিকের বাড়িও জামালপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ছাপার সময় সাইফুলকে প্রেসে থাকতে দেয়া হতো না। এতে করে সাইফুলের মনে প্রশ্ন জাগে। শেষ পর্যন্ত সাইফুল উত্তরার একটি মেসে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে সাইফুল তার বিয়াই প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুরের মাধ্যমে জানতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ছাপার কারণে তাকে প্রেসে থাকতে দেয়া হয় না। মেসে থাকা অবস্থায়ই সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় হয় চক্রের প্রধান রকিবুল ইসলাম ইসামীর সঙ্গে। রকিবুল রাজশাহীতে পড়াশোনা করে ঢাকায় আসে। সে ক্যামব্রিয়ান স্কুল এ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করতো। একই রুমে থাকার কারণে ইসামীর সঙ্গে সাইফুলের ঘনিষ্ঠতা হয়। ঘনিষ্ঠতার এক পর্যায়ে সাইফুল বিষয়টি রকিবুলের সঙ্গে আলাপ করে। রকিবুল সাইফুলকে আস্তে আস্তে থাকা খাওয়া, টিউশনি যোগাড় করে দেয়া, হাত খরচা বাবদ টাকা দেয়াসহ নানাভাবে অর্থায়ন করতে থাকে। এক পর্যায়ে খুবই ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর রকিবুল মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখায় সাইফুলকে। সাইফুল বিষয়টি নিয়ে তার বিয়াই খান বাহাদুরের সঙ্গে আলাপ করে। শেষ পর্যন্ত খান বাহাদুর প্রশ্নপত্র ফাঁস করার জন্য রাজি হয়ে যায়। রকিবুল তার লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। রাজশাহীতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। দুই লাখ থেকে সাত লাখ টাকায় একেকজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রশ্নপত্র আগাম ফাঁস করে দেয়ার চুক্তি করে। প্রশ্নপত্র সরবরাহ করার জন্য রকিবুল তার বোনের সাভারের বাসা ঠিক করে। সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। পরীক্ষার্থীদের আগেই সেখানে এনে রাখত। প্রশ্নপত্র প্রেসে যাওয়ার পর তা ফাঁস করে দিত খান বাহাদুর। খান বাহাদুরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পেয়ে সাইফুল তা রকিবুলের কাছে হস্তান্তর করে দিত। এভাবেই ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর শিখে পরীক্ষা দিত। পরবর্তীতে রকিবুলের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত হয় সাভারের বিকেএসপির একজন সহকারী পরিচালক। রকিবুল সরাসরি প্রশ্নপত্রের কপি নিয়ে ফাঁস করত। আর বিকেএসপির সহকারী পরিচালক প্রযুক্তিগতভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার বিষয়টি খান বাহাদুরকে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়। এজন্য ওই বিকেএসপি কর্মকর্তা খান বাহাদুরকে একটি দামি মোবাইল ফোন কিনে দেয়। মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে রাখে। এরপর তা হোয়াটসএ্যাপে পাঠিয়ে দিত ওই বিকেএসপি পরিচালকের কাছে। এই গ্রুপটির সঙ্গে যুক্ত থাকা শিক্ষার্থীদের কানের ভেতরে একটি সূক্ষ্ম ডিভাইস বসিয়ে দেয়া হতো। তারা পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পর বাইর থেকে প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়া হতো। তা কানে লাগানো যন্ত্রের মাধ্যমে শুনে উত্তর লিখত। একইভাবে ২০১৬ সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলমান আছে। তবে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী এই প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হয়েছে তা জানা যায়নি। চক্রের আরেক নেতাকে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ওই নেতা বিকেএসপির সহকারী পরিচালক। এই সিআইডি কর্মকর্তা জানান, চক্রের প্রধান রকিবুল ইসলাম ইসামী নন গেজেটেড কর্মকর্তা। নাটোর ও পাবনা জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার পিতার নাম মাওলানা ইসাম উদ্দিন। তিনি নাটোরের গুরুদাসপুরের শিকারপুর সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। স্থানীয় জামায়াত নেতা। রকিবুল রাজশাহীতে পড়াশোনা করার সময় ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। গত ১১ ডিসেম্বর রকিবুল ইসলাম ইসামীকে তার বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা ইসামী ও গুরুদাসপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে গ্রেফতার করা হয়। অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা চলতি বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত প্যানেলের মনোনীত সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে তিনি হেরে গেছেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। তিনি জামায়াতপন্থী শিক্ষক বলে জানা গেছে। রকিবুল ইসলাম ইসামীকে সিআইডির কাছ থেকে ছাড়ানোর জন্য বিচারক পরিচয়ে একজন ও তার ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা নানাভাবে অনেক তদবির করেছেন। তাদের নানামুখী তৎপরতার কারণে রকিবুল ইসলাম ইসামীকে গ্রেফতারে চালানো অভিযান তিন দফায় ব্যর্থ হয়েছে। চতুর্থবারের অভিযানে শেষ পর্যন্ত রকিবুলকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। রকিবুল ইসলাম ইসামী ২০১৬ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আগামী ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হচ্ছে। যাতে কোন পরীক্ষার্থী ভেতরে কোন প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস লুকিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। এ ছাড়া শিক্ষকসহ অন্যদেরও পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের বন্ধের বিষয়ে আলোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অসাধু উপায়ে ভর্তি হওয়াদের বিষয়ে তদন্ত চলমান থাকবে। যারা অসাধু পন্থায় ভর্তি হয়েছে, আইন মোতাবেক তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত যেসব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×