ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বীকারোক্তি অস্বীকার ফরহাদ মজহারের, চেপে গেলেন অর্চনার কথা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বীকারোক্তি অস্বীকার ফরহাদ মজহারের, চেপে গেলেন  অর্চনার কথা

শংকর কুমার দে ॥ কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার এক রহস্যময় পুরুষ। ফরহাদ মজহারের অপহরণের বিষয়টি রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তার নিখোঁজ থেকে ফেরত আসার পর পুলিশ চাপ দিয়ে ও মারধর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করার ঘটনাটি পুরোপুরি অস্বীকার করেছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশের তদন্তে অপহরণের সাজানো নাটক প্রমাণিত হওয়ার পর শনিবার রাতে শ্যামলীর নিজ বাসভবনে আকস্মিকভাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাকে পুলিশ তাকে চাপ দিয়ে মারধর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ফরহাদ মজহার। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহারের যার ‘গুরু বাবা’ সেই অর্চনা রানী যিনি নিজেকে তার ‘সেবাদাসী’ অভিহিত করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন তার নামটি বেমালুম চেপে গেছেন। গত ৩ জুলাই সকালে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বেরিয়ে কবি প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটিকে অপহরণের অভিযোগ এনে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়, যা পরে অপহরণ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। ডানপন্থী এই অধিকারকর্মীর অন্তর্ধান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সব মহলে আলোচনার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা পর গভীর রাতে নাটকীয়ভাবে যশোরে বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করে র‌্যাব-পুলিশ। তাকে উদ্ধারের পর অপহরণের সাজানো নাটকের ঘটনার প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয় সাক্ষ্য, প্রমাণ, আলামত হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে আদালতে দেয়া জবানবন্দী, ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও সেবাদাসী অর্চনার টেলিফোন কথোপকথনের অডিও, ভিডিও ইত্যাদির ভিত্তিতে তদন্ত করে পুলিশ। তদন্ত করে গত ১৪ নবেম্বর ফরহাদ মজহার অপহরণের মামলা ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় গোয়েন্দা পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইন্যাল রিপোর্ট) দাখিল করেন আদালতে। আদালতে দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ফরহাদ মজহার দম্পতি মিথ্যার আশ্রয় নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলার অনুমতি চেয়ে আবদেন করেছেন গোয়েন্দা পুলিশ। এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত। ফরহাদ মজহার দম্পতির মিথ্যা মামলা দায়ের করার শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, ফৌজদারি দ-বিধির ২১১ ধারায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কেউ কোন অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোন অপরাধ করেছে বলে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদ- বা অর্থদ- কিংবা উভয় দ- দেয়া যাবে। ফরহাদ মজহার অপহরণের নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করার ঘটনায় ফরহাদ মজহার দম্পতি ফেঁসে যান। তারপরই আকস্মিকভাবে শনিবার রাতে শ্যামলীর নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশের তদন্তকে মিথ্যা বলে চাপ দিয়ে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে বক্তব্য দেন ফরহাদ মজহার। এসব ঘটনা অস্বীকার করবে কিভাবে ॥ গত ৩ জুলাই ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনার দিন অপহরণের ঘটনার সময় থেকে উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত ১৮/১৯ ঘণ্টায় ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীর ফরিদ আক্তারের সঙ্গে অন্তত ১০ বার কথা বলেছেন। একই সময়ে ৬ বার কথা বলেছেন অন্য একটি নম্বরে। সে নম্বরে তিনি একটি ক্ষুদেবার্তাও পাঠিয়েছেন। পুলিশের কাছে এসব ঘটনার রেকর্ড আছে। ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে ফরহাদ মজহার স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, ৩০ লাখ টাকা তোমার কাছে রেখে দিও এবং তোমার কাছে ঐ টাকা চাইলে বলবে ডেলিভারি হয়ে গেছে। ফিরে এসে বাকিটা দেখব। খুলনা গিয়ে তিনি নিউমার্কেটে (খুলনা) গেছেন ও বের হয়েছেন। ওই দিন সন্ধ্যায় খুলনা থেকে অর্চনা রানীকে তার দুটি নম্বরের প্রথম দফা ১৩ হাজার টাকা ও দ্বিতীয় দফায় দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছেন ফরহাদ মজহার। সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিট ও সন্ধ্যা সাতটা ১৯ মিনিট। বাসের টিকেট নিজে ক্রয় করেছেন। তারও প্রমাণ তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের হাতে। ফরহাদ মজহারের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাবেক নারী কর্মী অর্চনা রানী যিনি তাকে গুরুবাব বলে সম্ভোধন করতেন এবং নিজেকে যিনি সেবাদাসী হিসেবে অভিহিত করতেন তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এসব ঘটনা অস্বীকার করবেন কিভাবে? পুলিশ সদর দফতরের অস্বীকার ॥ ফরহাদ মজহার নিখোঁজ থেকে ফেরত আসার পর পুলিশ চাপ দিয়ে ও মারধর করে মিথ্যা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে পুলিশ সদর দফতর। রবিবার পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেন, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী নেয়া হয়। এখানে মারধর, নির্যাতন বা জোর করার কোন সুযোগ নেই। এছাড়াও পুলিশ তাকে কোন ধরনের নির্যাতন করেনি। সহেলী ফেরদৌস আরও বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে। সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার যা বলেছেন সেটা তার নিজস্ব মতামত। এর আগে চলতি বছরের ৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টায় নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। নিখোঁজের পর তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের। তার সহকর্মীরা এ অপহরণের জন্য প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেন। ওইদিন সন্ধ্যায় ফরহাদ মজহারকে খুলনার হানিফ পরিবহনের ঢাকাগামী একটি বাস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের পর দীর্ঘ ১০ দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ জানায়, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছিলেন। সে সময় এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ফরহাদ মজহারের এ ঘটনাকে ‘অপহরণ নাটক’, ‘মিথ্যাচার’, ‘সাজানো গল্প’বলে উল্লেখ করেন। ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য তিনি এ ধরনের রটনা রটিয়েছেন’ বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের আইজি। এর আগে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করায় ফরহাদ মজহার দম্পতির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলার অনুমতি দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। আদালতের অনুমতি অনুযায়ী রাজধানীর আদাবর থানায় মামলা দায়েরের কথা ছিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার। আদালতের সিদ্ধান্ত দেখে ঘটনার ৫ মাস পর শনিবার অবশেষে এসব বিষয়ে মুখ খোলেন ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহারের অভিযোগ ॥ শনিবার রাতে শ্যামলীর নিজ বাড়িতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি নাটক করিনি, আমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করেছি। আদালতে দেয়া জবানবন্দী আমার না। আমাকে যা লিখে দেয়া হয়েছে, আদালতে তাই দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ‘গুম’ করার উদ্দেশ্যেই ধরে নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোরাল ভূমিকা রেখেছে, তবে পরে চাপ দিয়ে ও মারধর করে আমার কাছ থেকে ‘মিথ্যা’ স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরিবারের কাছে যেতে দেয়া হয়নি। অনেকক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি অফিসে বিধ্বস্ত অবস্থায় জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়ার জন্য লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন ফরহাদ মজহার। মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য ॥ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ফরহাদ মজহারের অপহরণ রহস্যজনক। রবিবার সকালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত র‌্যালি শেষে সংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, তার কথাবার্তা, আচার আচরণ রহস্যজনক। তিনি ৫ মাস পর এসে হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজের অবস্থান কেন জানান দিচ্ছেন? তিনি আরও বলেন, যারা গুম কিংবা নিখোঁজ হচ্ছেন, পুলিশের দায়িত্ব তাদের ফিরিয়ে আনা। তারা একা ফিরে এলে পুলিশ তদন্ত করবে। অপহরণ হলেও তদন্ত করবে। তবে পুলিশের দায়িত্ব বেশি। কাজী রিয়াজুল হক আরও বলেন, তিনি (ফরহাদ মজহার) যদি অপহৃতই হয়ে থাকবেন তবে তা তিনি আদালতে স্পষ্ট করে বলেননি কেন? আর উদ্ধারের পর তিনি সে রকম অসুস্থ ছিলেন না। তিনি চাইলে তখনই ঘটনা স্পষ্ট করতে পারতেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে- এমন কথাবার্তা ওঠায় তিনি সংবাদ সম্মেলন ডেকে কথা বলছেন। এটা আরও রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
×