ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুদানের দুর্গম মরুভূমে নিত্য শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের কমান্ডোরা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩০ নভেম্বর ২০১৭

সুদানের দুর্গম মরুভূমে নিত্য শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের কমান্ডোরা

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’। ভুপেন হাজারিকার গানের এই কলি সুদানের দারফুরে দারুণভাবে অনুভব করছি। হাজার হাজার মাইল দূরে এসে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী নিপীড়িত দারফুরের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা সেবা, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার উপকরণ তুলে দিয়ে প্রতিনিয়ত এই প্রমাণ রাখছে। যুদ্ধবিগ্রহে গৃহহীন মানুষ বাংলাদেশ সেনা সদস্যদের কাছ থেকে শান্তির ছায়া পাচ্ছেন। আট বছর ধরে দারফুর মিশনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী। এলজেনিনা মরু এলাকায় বাংলাদেশের একটি ক্যাম্প ব্যানএফআরসি-৩ পরিদর্শনে আসে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল। সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে বিমানপথে ১১ শ’ (সড়কপথে আড়াই থেকে তিন হাজার কিমি) কিলোমিটারের বেশি দূরে ক্যাম্পটির অবস্থান। দুই দফা ইউএন ফ্লাইট বদল করে এলজেনিনায় আসতে হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল আটটায় নায়ালা এয়ারপোর্ট থেকে জাতিসংঘের একটি ফ্লাইটে রওনা হয়ে এলফেসার এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে দুপুর দুটায় এলজেনিনা এয়ারপোর্টে নামতে হয়। এয়ারপোর্ট থেকে মরুভূমির ওপর দিয়ে ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার পথ গাড়িতে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ব্যানএফআরসি সুপার ক্যাম্প। প্রতিনিধিদল এখানে পৌঁছার পর কন্টিনজেন্ট কমান্ড কর্নেল তানভীর ইসলাম খান চৌধুরী ও মেজর বিজয় দেবাশীষ নারায়ণ পাল প্রতিনিধিদলকে ব্রিফ করেন। ব্রিফিংয়ে তাদের এখানকার কর্মকা-ের কথা তুলে ধরা হয়। তারা জানান, ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে ক্যাম্পে আনতে হয়। এখানে পানির প্রচ- অভাব। দুর্বিষহ জীবন যাপনের মধ্য দিয়েও তাদের মানবতার সেবা অব্যাহত রয়েছে। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন-রাতে নিয়মিত টহল দিতে হয়। সর্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। ‘যে কোন সময় বিদ্রোহীরা যে কোন জায়গায় আক্রমণ করতে পারে’ এমন একটি পরিস্থিতি সব সময় এখানে বিদ্যমান। তারা যাতে কোন এলাকায় আক্রমণ চালাতে না পরে সে জন্য রাতে টহল জোরদার করা হয়। জিম্মি উদ্ধার অভিযান, নতুন রাস্তা রেকি করাসহ যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সব সময় প্রস্তুত থেকে কাজ করছে বাংলাদেশী জোয়ানরা। ব্যানএফআরসি ইউনিট মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস কমান্ডোদের দিয়ে গঠিত। তারা দেশের জিম্মি উদ্ধার কাজের মতো বিদেশের মাটিতেও জিম্মি উদ্ধারের কাজ করছেন। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, দারফুর অন্য যে কোন মিশনের চেয়ে আলাদা। দারফুর মিশনকে বলা হয় ‘হাইব্রিড মিশন’। এখানে জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ২০০৩ সালের প্রথম দিকে দারফুরে সংঘটিত সংঘর্ষের ফলে মাত্র দুটি বড় বিদ্রোহী গ্রুপ ছিল। তারপর থেকে বিদ্রোহীরা প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে এখানে আটটি গ্রুপ সক্রিয় হয়। শান্তি মিশন স্থাপনের পর পাঁচটি গ্রুপ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। এখন তিনটি গ্রুপ মিলে একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। জাতিগত দাঙ্গার ইতিহাসটা নিষ্ঠুর ও নির্মমতায় ভরা। এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে হত্যা করে এখানে মেতে ওঠে হোলিখেলায়। আরব বংশীয়রা সরকারের সহযোগিতায় হত্যা করেছে সুদানী ফুরেস গোত্রীয় আদিবাসী মুসলিমদের। দারফুরে ৬০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। পলিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এমন এক জঘন্যতম হত্যাকা- চলেছে এখানে। সেই হত্যাকা-ের বদলা নিতেই বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জন্ম হয়। ফুররা ন্যায় বিচার ও সমতা আন্দোলন (জেম) নামে একটি দল গড়ে তুলেছে। এই দলের নেতা ছিলেন হাসান আল-তুরাবি। জেম যোদ্ধারা ২০০৮ সালের মে মাসে খার্তুমে হামলা চালায়। প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ১৯৮৯ সালের অভ্যুত্থানের নায়ক ছিলেন। তিনি সাদেক আল-মাহদীর নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন। জেম ২০০৮ সালের মে মাসে সুদানের রাজধানীতে একটি হামলা চালায়। ধীরে ধীরে জেমও দুর্বল হয়ে যায়। বর্তমানে সুদান লিবারেশন আর্মি (এসএলএ) দারফুর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম। দারফুরে তিনটি বৃহত্তম অ-আরব উপজাতি প্রধানত ফুর, জঘাওয়া এবং মাসালিত জনগোষ্ঠী রয়েছে। ফুর জনগোষ্ঠীর নেতা আব্দেল ওয়াহিদ মোহাম্মদ আল-নুরের নেতৃত্বাধীন দল, জাঘওয়া মিন্নি আর্কু মিনাওয়ির নেতৃত্বে চলছে। মিন্নির দল বর্তমানে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। চলতি বছর জুনে দারফুরে তিন বিদ্রোহী গ্রুপ সুদান লিবারেশন ফোর্স এ্যালায়েন্স নামে একত্রিত হয়েছে। তারা কোন যুদ্ধবিরতি চায় না। এসএলএফএ ঘোষণা করেছে, সুদানের লিবারেশন মুভমেন্ট ফর জাস্টিস, সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট-ইউনিটি এবং আদাল্লাহ বিশির জালির নেতৃত্বে বিচার ও সমতা আন্দোলন ‘মুক্ত এলাকা’ গঠন করবে। তাহরির আবু বকর হাজারে সভাপতি নির্বাচিত হন। নতুন সুদান লিবারেশন ফোর্স এ্যালায়েন্সের (এসএলএফএ) উপদেষ্টা আবদাল্লাহ ইয়াহিয় জালি সাধারণ কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। নতুন এই গ্রুপটি সুদান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এমন বিপদসঙ্কুল পরিবেশে ব্যানএফআর-৩ ক্যাম্পে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বাংলাদেশের কমান্ডোরা।
×