ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গেইল-ম্যাককালামকে ছাপিয়ে ব্যাটসম্যান মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

গেইল-ম্যাককালামকে ছাপিয়ে ব্যাটসম্যান মাশরাফি

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ প্রয়োজনে যোদ্ধার ভূমিকায় দাঁড়াতে পিছপা হওয়া দূরের কথা, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই চিরকালীন অভ্যাস। মাশরাফি বিন মর্তুজা সেই প্রমাণটা দিয়েছেন ক্যারিয়ারে অনেকবারই। আরেকবার প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রামের ক্রিকেটপ্রেমীরা। শনিবার রাতে হঠাৎ করেই তিন নম্বরে নামলেন ব্যাটসম্যান মাশরাফি বিন মর্তুজা। অথচ একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে গতিময় পেসার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামে। দলের প্রয়োজনে স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের বাদ দিয়ে লড়াই করতে নামলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। আর লজ্জা দিলেন বিশ্বের মারকুটে সব ব্যাটসম্যানদের মাত্র ১৭ বলে রানের ইনিংস খেলে। এমনটা তার পক্ষেই সম্ভব। কারণ তিনি লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডধারী! অথচ এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে সবচেয়ে আলোচিত দুই ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল ও ব্রেন্ডন ম্যাককালাম তারই দল রংপুর রাইডার্সে। টানা তিন ম্যাচে বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান ম্যাককালাম কিছুই করতে পারেননি, রানের চেয়ে বল হজম করেছেন বেশি। বিধ্বংসী গেইল প্রত্যাশা মাফিক ব্যাট চালাতে পারছিলেন না এদিন। তবে গেইলের আশেপাশে কেউ নেই এটাও মাশরাফি দাবি করেছেন ম্যাচ শেষে। গত ১৮ নবেম্বর রংপুরের হয়ে মাঠে নামেন গেইল-ম্যাককালাম। এর আগ পর্যন্ত দলের অবস্থা ছিল বেশ বিপর্যস্ত। কিন্তু এ দুই ভয়ঙ্করতম ব্যাটসম্যানকে পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে দলটি। কিন্তু দু’জনের ব্যর্থতায় সেই ম্যাচেও হারতে হয়েছে। পরের ম্যাচটিতে অবশ্য দারুণ ব্যাটিং করেছেন দু’জনই, দলও জয় পেয়েছে। এরপর বাকি তিন ম্যাচে আর এ দুইজনের জুটি জমেনি। আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে সর্বাধিক রানের মালিক ম্যাককালামের ব্যাটিং দেখে উল্টো মনে হয়েছে যেন নবিশ ব্যাটসম্যান তিনি। অথচ দুইমাস আগে শেষ হওয়া ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। সেই ম্যাককালাম বিপিএলের ৫ ম্যাচে করেছেন ১৩, ৩৩, ৬, ২ ও ১৫। এর মধ্যে ২১ বলে ৩৩ রানের ইনিংসটিই শুধু চিনিয়েছে তাকে। বাকি ম্যাচগুলোতে রানের চেয়েও খেলেছেন বেশি বল। তবে গেইল দুই ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। শনিবার রাতে চিটাগং ভাইকিংসের বিরুদ্ধে প্রয়োজন ছিল আরও ঝড়ো ব্যাটিং। সেক্ষেত্রে স্বীকৃত গেইলের ব্যাটের দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন মাশরাফিসহ দলের সবাই। কিন্তু নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি ম্যাককালাম, ২০ বলে করেছেন ১৫। আর গেইলও যেন ঝিমুচ্ছিলেন। তখনই ব্যাট হাতে নেমে ১৭ বলে ৪ চার ও ৩ ছক্কায় ৪২ রানের একটি বিস্ফোরক ইনিংস খেলে দু’জনেরই যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে ব্যাট চালাতে হবে। মাশরাফির শুরুর সেই ঝড়েই শেষ পর্যন্ত জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে রংপুর। তিনি ব্যাট শুরুর পর একেবারে ম্লান হয়ে যান গেইল। মাশরাফির যখন ১২ বলে ২৮, গেইলের তখন ১৬ বলে ১৮ রান! শেষ পর্যন্ত ২৪৭.০৫ স্ট্রাইকরেট নিয়ে ৪২ রানে সাজঘরে ফেরেন তিনি, তখন গেইলের স্ট্রাইকরেট ছিল ১৩২! ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেও ব্যাটিং পারদর্শিতার জন্য বেশ পরিচিতি ছিল মাশরাফির। মাঝে মাঝেই তার ব্যাট থেকে ঝড়ো কিছু ভাল ইনিংস বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ক্যারিয়ারের সিংহভাগই তার কেড়ে নিয়েছে ইনজুরি। তাই অনেকে দুঃখ নিয়েই বলেন, বাংলাদেশ দল একজন ভাল মানের পেস অলরাউন্ডার পেয়েও হারিয়েছে। পরিচয়টা যখন দিয়েছিলেন তখন মাত্র ১৭ বছরের কিশোর মাশরাফি। বাংলাদেশে আয়োজিত অনুর্ধ-১৭ এসিসি এশিয়া কাপে কুয়েতের বিরুদ্ধে ৮ নম্বরে নেমে ১৭ বলে ৪টি চার ও ৬ ছক্কায় ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস। তবে পেসার মাশরাফিকে দেখতেই সেদিন বিকেএসপির দুই নম্বর মাঠে গিয়েছিলেন সবাই। এর আগে মাত্র ১৬ মিনিটে ব্যাটিং প্রতিভাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই মাশরাফি তার ব্যাটিং ও বোলিং প্রতিভায় বাংলাদেশ দলকেও জিতিয়েছেন বেশ কয়েকটি ম্যাচ। ২০১৫ বিপিএলে দুর্বলতর একটি দল ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। কিন্তু ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পাশাপাশি অভূতপূর্ব নেতৃত্বে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেবারও ব্যাট হাতে তাকে নামতে দেখা গেছে ৪/৫ নম্বরে। সেই প্রমাণটা এমনকি প্রিমিয়ার ক্রিকেট লীগেও দেখিয়েছেন ব্যাটিং প্রতিভা। গত বছর ফতুল্লায় শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের বিরুদ্ধে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের পক্ষে মাত্র ৫১ বলে ১১ ছক্কা ও ২ চারে ১০৪ রানের ইনিংস খেলেন। মাত্র ৫০ বলে শতক ছুঁয়ে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের ইতিহাসে বাংলাদেশী কোন ব্যাটসম্যানের পক্ষে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এবার নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়ানো গেইলদেরও দেখিয়ে দিলেন নিজের ব্যাটিং প্রতিভা। তবে ম্যাচশেষে এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘গেইলের রেকর্ড দারুণ। সাড়ে ১০ হাজার রান করেছেন তিনি এই সংস্করণে। সে রাজাদের একজন এই সংস্করণের। ওর আশেপাশে আসলে কেউ নেই।’ তবে গেইল দুই ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকালেও নিজের সেরা বিধ্বংসী চেহারাটা এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেননি। আর ম্যাককালাম তো পুরোপুরিই নিষ্প্রভ। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘ওরা চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে যেটা হয়, এই উইকেটে রান করা খুবই কঠিন। আমার কাছে মনে হয়, সবচেয়ে কঠিন টি২০ টুর্নামেন্টের একটি বাংলাদেশের। কারণ বাংলাদেশে রান করা এত সহজ নয়। উইকেট হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হয়ে যায়, হুট করে ধীরগতির হয়। আবার খুব ভাল করলে রান করা সহজ।’ তবে এমন ব্যাটিং প্রতিভা, আর দারুণ বোলিং নৈপুণ্যের পরও আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন মাশরাফি। মাশরাফি কি সামনের ম্যাচগুলোতেও তিনে নামবেন? এটির নিশ্চয়তা অবশ্য তার কাছে নেই। দলের প্রয়োজনে নেমেছিলেন। তিনি বলেন, ‘অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। কোন প্রত্যাশা জাগিয়ে নামতে চাই না। শনিবার দলকে জেতানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত ছিল।’ বল হাতেও চলতি বিপিএলে প্রতি ম্যাচেই ভাল বোলিং করেছেন মাশরাফি। ৮ ম্যাচে মাত্র ৬.৪১ ইকোনমি রেটে উইকেট নিয়েছেন ৯টি। এবার ব্যাট হাতেও জ্বলে উঠলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক।
×