নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ চিকিৎসাধীন এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর সোমবারও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। হাসপাতালে রোগীর আগমন কম ছিল। এদিকে কলেজ অডিটরিয়ামে হাসপাতালের কর্মকর্তা, চিকিৎসকদের নিয়ে বিএমএ নেতাদের জরুরী বৈঠকে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে এ ঘটনায় নিহতের চার স্বজনের নাম উল্লেখ এবং ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রবিবার দুপুর দেড়টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত নওশাদের (৫২) মৃত্যু হয়। এ নিয়ে তার স্বজনরা চিকিৎসকদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। রোগীর স্বজনের হামলায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ শামিমুর রহমান শামিম, শাওন ও সায়েম নামে তিনজন আহত হন। এদের মধ্যে চিকিৎসক শামিমুর রহমান শামিমের হাত ভেঙ্গে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালের ৩৫নং কেবিনে ভর্তি করা হয়। সংঘর্ষে বাদল, শাহআলমসহ চার আনসার সদস্য আহত হন। চিকিৎসকদের হামলায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে দুজন আহত হয়েছেন।
সূত্র জানায়, রবিবারের ঘটনার পর সোমবার হাসপাতালের বহিঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগে রোগীর সংখ্যা কম ছিল। দুপুর পর্যন্ত বহিঃবিভাগে প্রায় দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, যা অন্যদিনের তুলনায় অর্ধেক। এদিকে ঘটনার পর হাসপাতালে আনসার সদস্যদের কড়া পাহারা ছিল। অনেক দর্শনার্থীকে ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। হাসপাাতাল-২-এর নতুন ভবনের দুই গেটে আটজন আনসার সদস্য পাহারা দিয়েছেন। কোন দর্শনার্থীকে সন্দেহ হলে তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে রোগীদের ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। আগত রোগীর স্বজনরা জানান, রোগী নিয়ে এমনিই নানা মানসিক চাপ থাকে। তার ওপর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে আনসারদের হাতে নাজেহাল হতে হয়েছে।
এদিকে সোমবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অডিটরিয়ামে হাসপাতালের কর্মকর্তা, চিকিৎসকদের নিয়ে জরুরী বৈঠক করেছেন বিএমএ নেতারা। বৈঠকে রবিবার হাসপাতালে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। এমনকি এ ঘটনায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়। এ সময় হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা চিৎকার-চেঁচামেচি করে শোরগোল শুরু করেন। একপর্যায়ে কয়েক ইন্টার্ন চিকিৎসক মিছিল করে অডিটরিয়াম থেকে বের হয়ে যান। এ সময় সভা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, হাসপাতালে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও যাতে রোগীর চিকিৎসাসেবা বন্ধ না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। বৈঠকে বিএমএ নেতৃবৃন্দ, হাসপাতালের পরিচালক, কলেজ প্রিন্সিপালসহ চিকিৎসকরা ছিলেন।
অন্যদিকে সংঘর্ষের পর রবিবার রাত সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-২-এর ওয়ার্ড মাস্টার মোঃ রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় রোগীর স্বজন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, মাকসুদ, মোঃ ফারুক হোসেন, ইকবাল হোসেনসহ ১০-১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, সিসিইউতে ব্যাপক ভাংচুর করে রোগীর স্বজনরা। এতে এক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় শুয়ে ডাঃ শামিম জানান, সব রোগীকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সেবা করি। কারণ রোগীদের সেবা করাই আমাদের কাজ। যে রোগীকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম, দফায় দফায় রোগীর পরিবার ও স্বজনদের ব্রিফ করলাম, তারাই আমাকে মারলেন, আমার হাতটা ভেঙ্গে দিলেন। এর আগে কখনও এভাবে অপদস্ত হইনি। শুধু হাত নয় ভাই, হৃদয়টাও ভেঙ্গে গেছে। ঘটনা সম্পর্কে ডাঃ শামিম বলেন, রবিবারও আমি কয়েক দফায় স্বজনদের রোগীর সর্বশেষ অবস্থা ব্রিফ করেছি। রোগীর অবস্থা এখানে ভর্তির আগেই খারাপ ছিল। হার্ট এ্যাটাকের তিন দিন পর এখানে আনা হয়। হার্ট এ্যাটাকের সিরিয়াস স্টেজে ছিলেন ওই রোগী। বাঁচা-মরার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া কোন ডাক্তারের হাতে নেই। ডাঃ শামিম আরও জানান, তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারধর শুরু করে। নারী ডাক্তারদের ওপর চেয়ার ছুড়ে মারে। সিসিইউতে ভাংচুর চালিয়েছে তারা। আনসার সদস্যদেরও মারধর করেছে। এর কোনটাই মানার মতো নয়। আমার হাত ভেঙ্গে গেছে। হাতের হাড়ে ফ্র্যাকচার ধরা পড়েছে। এখন চিকিৎসাসেবায় থাকা তো দূরের কথা, হাঁটাচলাও বন্ধ হয়ে গেল। হাতের সঙ্গে আমার হৃদয়টাও ভেঙ্গে গেছে। ডাঃ শামিমের বাবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. মোঃ মেহেদি মাসুদ ছেলেকে দেখতে এসে জানান, সিরিয়াস রোগী মারা গেলে ডাক্তারদের দোষ কী? আমার আরেক ছেলেও ডাক্তার। এই ঢামেক থেকেই পাস করেছে। শামিমও বিসিএস দিয়ে ডাক্তারই হয়েছে। ওর ইচ্ছা মানুষের সেবা করবে। এই যদি হয় ডাক্তারের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, তবে এ পেশা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভীষণ খারাপ লেগেছে। এটা মানা যায় না।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: