ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রাস্তা

মাছের ঘেরে ৭০ সড়কে ধস

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

মাছের ঘেরে ৭০ সড়কে ধস

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেশবপুর, ২৭ অক্টোবর ॥ নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় দখলের পাশাপাশি কেশবপুরের মাছের ঘের ব্যবসায়ীরা শতাধিক সরকারী রাস্তা দখল করে মাছের চাষ করছে। আর মাছের ঘেরে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে সড়কগুলো ধসে পড়ছে। ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের করা হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে শহর ও গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থা। স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক সড়কের পাশ দিয়ে আলাদা বেড়িবাঁধ নির্মাণের নির্দেশ দিলেও ঘের মালিকরা তা মানছে না। এ নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে ঘের মালিকদের কয়েক দফা বসাবসি হলেও সড়ক ব্যবহার বন্ধ কার্যকর হচ্ছে না। কেশবপুরের ঘের মালিকরা ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে সরকারী রাস্তা ব্যবহার করায় এ উপজেলার প্রধান সড়কসহ গ্রামীণ শতাধিক পাকা ও ইটের সোলিং সড়ক ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, কেশবপুর-পাঁজিয়া সড়ক, কেশবপুর-ভেরচী সড়ক, কেশবপুর-ফতেপুর সড়ক, কলাগাছী-চুকনগর সড়ক, মঙ্গলকোট-হিজলডাঙ্গা সড়ক, মঙ্গলকোট-পাঁচপোতা সড়ক, বাঁকাবরশি-গড়ভাঙ্গা সড়ক, মজিদপুর-লক্ষ্মীনাথকাটি সড়ক, কেশবপুর-ত্রিমোহিনী সড়ক, ত্রিমোহিনী-সাগরদাঁড়ি সড়কসহ অর্ধশত পাকা সড়ক, মনোহরনগর-বাঁকডাঙ্গা সড়ক, ব্যাসডাঙ্গা-ইমাননগর সড়ক, শ্রীফলা-মঙ্গলকোট সড়ক, সাবদিয়া-বাজিতপুর সড়কসহ প্রায় ৭০টি ইটের সোলিং সড়ক ধসে নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে এসব সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ, ছোট-বড় যানবাহন চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ফকির রাস্তা থেকে কেশবপুর বাস-ট্রাক টার্মিনাল পর্যন্ত বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছের ঘের করেছেন ঘের মালিক সুলতান। কেশবপুর-পাঁজিয়া সড়ক, ব্যাসডাঙ্গা সড়কসহ কমপক্ষে ১০টি পাকা সড়ক বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে ঘের করেছেন অপর ঘের মালিক সেলিমুজ্জামান আসাদ। মঙ্গলকোট-হিজলডাঙ্গা সড়কের দু’পাশ বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে হাজোয়ার বিল ও চোহার বিলে ঘের করেছেন ইলিয়াস হোসেন, মহসিন হোসেন। মঙ্গলকোট-পাঁচপোতা সড়ক বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছের ঘের করেছেন কেশবপুর বাজারের জুতা ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন। ত্রিমোহিনী-সাগরদাঁড়ি সড়কের পদ্মবিলে ঘের মালিক কামরুজ্জামান বিশ্বাসসহ অর্ধশত ঘের মালিক পাকা ও সোলিং রাস্তা ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। জানা গেছে, উপজেলার ঘের মালিকরা ২১টি সরকারী খালের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে মাছের ঘের করছেন। কেশবপুর উপজেলায় পরপর দু’বছর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ মাছের ঘের। মাছের ঘেরের কারণে একদিকে যেমন বিল, বাঁওড় এবং নিচু জলাশয়ে আউশ, আমান আবাদ হচ্ছে না, অন্যদিকে হাজার হাজার হতদরিদ্র পরিবার বিলে মাছ শিকার করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেশবপুর পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়নে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার বিল ও জলাশয় রয়েছে। বিলগুলোর মধ্যে বিল বলদহালি, টেপুর বিল, বিল গরালিয়া, পদ্মবিল, ঘোচ মারার বিল, কাদার বিল, মহাদেবপুর বিল, পাঁচপোতার বিল, হাজোয়ার বিল, বিল খুকশিয়া, বোয়ালিয়ার বিল, বিষ্ণুপুর বিল উল্লেখযোগ্য। আশির দশকে এসব বিলের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত হাজারও জেলে সম্প্রদায়ের লোক। ওই সময় বিলগুলোর বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল থাকায় ধান, পাট, মসুরি, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হতো। নব্বই দশকে এসব খাল-বিল, নদ-নদী দখল করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাছ চাষ শুরু করে এবং ঘের মালিকরা গ্রামীণ প্রধান প্রধান সড়কগুলো ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে বিলের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার জেলে সম্প্রদায়ের লোক ও হতদরিদ্র মানুষের বিলের মাছ শিকার বন্ধ হয়ে যায় এবং নিচু এলাকার বৃষ্টির পানি বেরোনোর পথ বন্ধ হয়ে যায়। ঘের মালিকরা সরকারী খালের পানি নিষ্কাশনের পথ সøুইসগেট ও কালভার্ট এবং খালের মুখে ব্যক্তিগতভাবে পাকা কালভার্ট নির্মাণ করে পানি বেরোনোর পথ বন্ধ করে দেয়। এভাবে নদী ও খাল দখল করে মাছ চাষ করার কারণে কেশবপুর উপজেলাব্যাপী দেখা দেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার কারণে বিলে ফসল আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০০ সালের দিকে এসব বিলের ওপর নির্ভরশীল কৃষকরা ঘের মালিকদের হাত থেকে বিল উদ্ধার করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু ঘের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে আন্দোলনরত কৃষকদের বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে হয়রানি করতে থাকে বলে কৃষকদের অভিযোগ। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মুনছুর আলী জানান, মাছের ঘের মালিকরা অবৈধভারে সড়ক বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষ করছেন। ফলে সড়কের পাশের ঢাল ও সোল্ডারসহ পিচের রাস্তা ভেঙ্গে পড়ছে। সরকারী নিয়মে সড়কের পাশে ছয় ফুট বাঁধ রেখে আলাদা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। ঘের মালিকদের সেভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য পত্র দেয়া হলেও তারা নিয়ম অমান্য করে সড়ক বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করছে। উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর কবীর বলেন, কেশবপুর উপজেলায় চার হাজার ৬শ’ ১৭টি মাছের ঘের রয়েছে, যার মধ্যে ছয় হাজার ৫শ’ ৫৫ হেক্টর জমি জলাকার। ঘের মালিকরা ২১টি সরকারী খাল দখল করে মাছ চাষ করছে। তবে ঘের সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা হয়েছে, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তখন আর ঘের মালিকরা ইচ্ছামতো ঘের করতে পারবে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে সকল নদী ও খাল দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে অনেক খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে মাটির অভাবে সড়কের পাশ দিয়ে আলাদা বাঁধ করা যাচ্ছে না। আগামী শুষ্ক মৌসুমে সকল ঘের ব্যবসায়ীকে সড়কের পাশে আলাদা বাঁধ করে মাছের ঘের করতে বাধ্য করা হবে।
×