ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাহমিনা আক্তার লিমা

প্রোটিয়া ভূমিতে পুরনো চেহারায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৪ অক্টোবর ২০১৭

প্রোটিয়া ভূমিতে পুরনো চেহারায় বাংলাদেশ

সর্বশেষ ২০০৭ সালের জুলাইয়ে কলম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৬২ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ইনিংস। সেটাই ছিল ১০০ রানের নিচে সর্বশেষবার গুটিয়ে যাওয়া। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ইনিংসটি ছিল ১০২ রানের। এবার তারচেয়েও বড় লজ্জাকে বরণ করল বাংলাদেশ দল। গত ১০ বছরে এটাই প্রথম ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ ১০ বছর আগের দুঃসহ স্মৃতি মুশফিকদের ফিরিয়ে দিল পোচেফস্ট্রুম। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাটিং, লজ্জাজনক হার। বেহাল বোলিং-ফিল্ডিং। এতকিছুর সম্মিলন গত কয়েক বছরে খুব কমই দেখা গেছে বাংলাদেশ দলের কাছ থেকে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে পোচেফস্ট্রুমে যা করল তারা দ্বিতীয় ইনিংসে তেমনটা টেস্ট ক্রিকেটে গত ১০ বছর দেখেনি বাংলাদেশ দল। এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের প্রথম টেস্টেই সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছে। ৩৩৩ রানের বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছে পোচেফস্ট্রুমের সেনওয়েস পার্কে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে। হারের ব্যবধানটা এখানে যতটা না লজ্জার, তারচেয়ে লজ্জার বিষয় দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং দৈন্যতা, ব্যাটিং উইকেটেও প্রতিপক্ষের কাছে নিজেদের বিলিয়ে আসার পুরনো সেই বিভীষিকাময় অতীত রোমন্থনের তিক্ততা। ৪২৪ রানের জয়ের লক্ষ্যে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যানদের উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার মিছিলে মাত্র ৯০ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে এই প্রথম ১০০ রানের নিচে অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সর্বনি¤œ টেস্ট ইনিংস খেলেছে। ভুলটা ম্যাচ শুরুর আগেই করেছিলেন মুশফিক। সেটার খেসারত দিতে হয়েছে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মাঠে বল কুড়াতে কুড়াতে। বোলাররা কোন পাত্তাই পায়নি প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের আগ্রাসনের সামনে। শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেটে ৪৯৬ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে প্রথম ইনিংস ঘোষণা দেয় স্বাগতিকরা। পরে ব্যাটিংয়ে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বোচ্চ ৩২০ রান করে বাংলাদেশ। কিন্তু ১৭৬ রানে পিছিয়ে থাকাটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় চাপ। আর সেনওয়েস পার্কটা একেবারেই অপরিচিত হওয়ার প্রভাবটাও পড়েছে। আর সে কারণে বাংলাদেশ দলের বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ের অতীতের সেই বেহাল দশাই পরিলক্ষিত হয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে অনেক হতাশার স্মৃতিকে। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে নিজেদের সর্বাধিক সংগ্রহ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে সর্বনি¤œ সংগ্রহÑ এই দুটি আকাশ-পাতাল তুল্য বিস্তর ফারাকের কারণেই লজ্জাজনক পরাজয় মানতে হয়েছে। ৩০০ রানের বেশি ব্যবধানে এর আগে ৪ বার হেরেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় পরাজয় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ৪৬৫ রানে। এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিলে হারারেতে জিম্বাবুইয়ের কাছে ৩৩৫ রান। এরপরই তৃতীয় অবস্থানে এই হার। পুরনো সেই দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের কঙ্কালসার ব্যাটিং চিত্রটা ভালভাবেই প্রদর্শিত হলো সেনওয়েস পার্কে। তবে এই হারের পেছনে টস জিতেও ব্যাটিং স্বর্গে প্রথমে ফিল্ডিং নেয়া এবং মূলত বোলারদের ব্যর্থতাকেই দুষেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। বড় রানের চাপে পড়েই ব্যাটসম্যানরা ভাল করতে পারেনি বলে দাবি তার। অপরদিকে ম্যাচ জয়ের পেছনে বোলারদেরই কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রোটিয়া অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিস। বিশেষ করে ব্যাটিংবান্ধব ফ্ল্যাট উইকেটে আগে ব্যাটিং না নেয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণেই এমনটা হয়েছে। এ বিষয়ে মুশফিক বলেন, ‘আমি আসলেই বুঝিনি উইকেট এমন ফ্লাট হবে। আমি ভেবেছিলাম প্রথম ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলতে পারবে না। সেই ভুলটা আমাদের ব্যবধান গড়ে দিয়েছে। তবে আমাদের বোলাররাও প্রত্যাশা অনুসারে বোলিং করতে পারেনি।’ উইকেট যে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা একদ-ও বুঝে উঠতে পারেননি সেটা বোঝা গেছে ম্যাচ শুরুর পরে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা যেখানে বাংলাদেশী বোলারদের কোন পাত্তাই না দিয়ে অনায়াসে রানের পাহাড় গড়েছেন, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা উইকেট বিলিয়ে এসেছেন। পেসবান্ধব পরিবেশেও দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনার কেশব মহারাজ উইকেট তুলে নিয়েছেন ৩টি। সমানতালে তিনি দলের পেসারদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের ইনিংসকে বেশিদূর যেতে দেননি। সেই উইকেটে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের বোলাররা কিছুটা ভাল করলেও অন্যতম স্পিনার হিসেবে থাকা মেহেদি হাসান মিরাজ থেকেছেন উইকেটশূন্য। অথচ অনিয়মিত বাঁহাতি অর্থোডক্স মুমিনুল হক তিনটি দারুণ উইকেট শিকার করেন। ১০ টেস্টের ক্যারিয়ারে এই প্রথম মিরাজের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিষাদের বিষয় আছে আরও। সবচেয়ে বেশি রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকার রেকর্ডে মিরাজের অবস্থান হয়েছে টেস্ট ইতিহাসে তিন নম্বরে, আর বাংলাদেশের হয়ে সবার ওপরে। সবমিলিয়ে ৬৭ ওভার বোলিং করে (৫৬ ও ১১ ওভার) ২৪৭ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি মিরাজ। তালিকার এক নম্বরে প্রোটিয়া স্পিনার ইমরান তাহির। তিনি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এ্যাডিলেড টেস্টে ২৬০ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি। দুইয়ে সাবেক পাকিস্তানী পেসার খান মোহাম্মদ, ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জ্যামাইকা টেস্টে ২৫৯ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। পেসস্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমান অবশ্য দারুণ বোলিং করেছেন। তিনি দুই উইকেট তুলে নেন। প্রথম ইনিংসেও বেশ ভাল বোলিং করেছিলেন তিনি। তবে মিরাজ আর মহারাজের বোলিং নৈপুণ্য বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কথা। তিনি ছুটি নিয়ে বর্তমানে বিশ্রামে আছেন, দুই টেস্টের সিরিজে খেলছেন না তিনি। অন্যতম স্পিনস্তম্ভ এ বাঁহাতি সর্বশেষ ২০০৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও দুই টেস্টে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। এবার পুরোপুরিই সেই ঘাটতিটা বাংলাদেশের জন্য বড় হয়ে গেছে। চতুর্থদিন শেষে ৩ উইকেটে ৪৯ রান নিয়ে দিন শেষ করার পর মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় বড় ব্যবধানে হারতে চলেছে বাংলাদেশ। সেটাই সত্যি হয়েছে। আগেরদিন পিঠের ব্যথার কারণে মাঠ ত্যাগ করা ভয়ানক মরকেল পঞ্চমদিন না নামলেও কাগিসো রাবাদার গতির ঝড়ে বেসামাল হয়ে গেছে বাংলাদেশের টপঅর্ডার। বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা প্রোটিয়া পরিবেশে যে একেবারেই অসহায় সেটা বোঝা গেছে এই ইনিংসেই। দুর্দশাগ্রস্ত চেহারা ফুটে উঠেছে বিশাল ব্যাটিং লাইনআপ থাকা সত্ত্বেও। পেসারদের বিরুদ্ধে তো অবশ্যই, এমনকি স্পিনারদেরও ঠিকমতো মোকাবেলা করতে পারেননি কোন ব্যাটসম্যান। অন্যতম ভরসা তামিম ইকবাল উভয় ইনিংসে হয়েছেন ব্যর্থ। আর সৌম্য সরকারের অনুপস্থিতিতে ওপেনিংয়ে ফিরে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন ইমরুল কায়েস। প্রস্তুতি ম্যাচে জোড়া ফিফটি হাঁকানো সাব্বির রহমান দুই ইনিংসেই হতাশ করেছেন। তবে বড় প্রাপ্তি অবহেলিত মুমিনুল ও মাহমুদুল্লাহর ব্যাটে রান। তারা কঠিন জবাবই দিয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্টকে। প্রথম ইনিংসে মুমিনুল সর্বোচ্চ ৭৭ এবং মাহমুদুল্লাহ ৬৬ রান করেন। তাদের জুটির কল্যাণেই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবার ফলোঅন এড়ায় বাংলাদেশ দল। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে খেলা ৯ টেস্টের মধ্যে ৭টিতেই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ঢাকা টেস্টে ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম, হেরেছিল মাত্র ৫ উইকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৯০ রানে মুখ থুবড়ে পড়ার কারণে এবার সেটার চেয়েও বাজে ফলাফল হলো। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এই প্রথম ইনিংস হার ঠেকিয়েছে বাংলাদেশ দল এটাই হয়তো সান্ত¡নার কথা হতে পারে। কিন্তু দলের উন্নতি খুব কমই হয়েছে সেটাও পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। পেসবান্ধব উইকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কতটা অসহায় সেই চিত্রই পরিষ্কার হয়েছে সেনওয়েস পার্কে। ক্রমোন্নতির গ্রাফ বেশ খাঁড়া থাকা দলটির এমন নৈপুণ্য দারুণ হতাশার। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আগে কখনও এমনটা হয়নি। তাই উন্নতিটা যেন বিদেশের মাটিতে আসেইনি বাংলাদেশ দলের। এ বিষয়ে মুশফিকও হতাশা নিয়ে বলেছেন, ‘শেষবার ১০০ রানের নিচে আমরা কবে অলআউট হয়েছিলাম তা আমার মনে নেই। আমি সত্যিই হতাশ। আমাদের আসলে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। সবমিলিয়ে যেখানে প্রয়োজন উন্নতি করতে হবে। বোলাররা প্রত্যাশা অনুসারে বোলিং করতে পারেনি। যার কারণে প্রথম ইনিংসে বড় রানে পিছিয়ে থাকাই চাপ হয়েছে। এরপরও এমন ব্যাটিংয়ের জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
×