ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন প্রজন্মের সন্ধানী

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ অক্টোবর ২০১৭

নতুন প্রজন্মের সন্ধানী

ডিপ্রজন্ম- সন্ধানীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই- এস আই প্রবাল- প্রথমেই ধন্যবাদ ডিপ্রজন্ম এবং আপনাকে। সন্ধানী মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্রছাত্রীদের পরিচালিত একটি সংগঠন। সন্ধানী ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৪১ বছর মানব সেবায় নিয়োজিত আছে। সন্ধানীর ভিত্তিটাই ছিল মানবসেবার উদ্দেশ্যে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর ছয় শিক্ষার্থী দ্বারা যারা কিনা নিজেদের এক বন্ধু যে কিনা টাকার অভাবে সকাল থেকে কিছু না খেয়ে সারাদিন মেডিকেলে ক্লাস করত তাকে সাহায্যের জন্যই এই সন্ধানীর প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। এরপর ১৯৭৮ সালের ২ নবেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে ২ নবেম্বরকে জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এ দ্বিতীয় ইউনিট প্রতিষ্ঠা হয়। সেই চারা আজ বটবৃক্ষে পরিণত হয়ে সারা বাংলাদেশে ২১টি ইউনিট এবং ৯টি ডোনার ক্লাবের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সন্ধানীর বর্তমান কার্যক্রম এর মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান এ উদ্বুদ্ধকরণ, ড্রাগ ব্যাংকের সাহায্যে গরিব রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা করা, যে কোন দুর্যোগ এ ত্রাণ কার্যক্রম এবং হেলথ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা, শীতবস্ত্র প্রদান, এতিম দুস্থ বাচ্চাদের ঈদে ঈদবস্ত্র ও বিভিন্ন বৃত্তি প্রদান, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তযোগাড়, কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা থেকে ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। খুব বেশিদিন আগে না, সন্ধানীর পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জ হাওরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বিতরণ করা হয়, রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ঘর-বাড়ি তৈরি করার উদ্দেশ্যে নগদ টাকা সাহায্য দেয়া হয়। উত্তরবঙ্গে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, হেলথ ক্যাম্প এবং ১২ টি পরিবারে ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। এছাড়া কিছুদিনের মধ্যেই রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে হেলথ ক্যাম্পের আয়োজন করতে যাচ্ছে। ডিপ্রজন্ম- কবে যোগ দিলেন, কতগুলো ধাপ পার করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হলেন? এস আই প্রবাল- এই ক্ষেত্রে প্রথমেই সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ কিভাবে গঠিত হয় সেটা জানাতে চাই। প্রত্যেক বার্ষিক সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে প্রত্যেকটি ইউনিটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ইউনিটসমূহের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত হয়। এছাড়াও ইউনিটসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ এর সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আমি ২০১৩ সালে মেডিকেলে ভর্তির পর সন্ধানী গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগদান করি। এরপর যুগ্ম রোগী কল্যাণ সম্পাদক-১, রোগী কল্যাণ সম্পাদক এবং গত বছর সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল ২০১৭ এ ৩৬ তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক সম্মেলন এ সন্ধানী গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ইউনিটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হই। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্ধানী রংপুর মেডিকেল কলেজ ইউনিটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি রিদওয়ান জুবায়ের রিয়াদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে সুফিয়ান সিদ্দিকী নির্বাচিত হয়। ডিপ্রজন্ম- প্রবাল, আপনার সম্পর্কে জানান- এসআই প্রবাল- আমার বাবা মোঃ শফিকুল ইসলাম ২০০৭ সাল পর্যন্ত সরকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর কিডনি নষ্ট হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আমরা ৩ ভাইবোনের সব দায়িত্ব আমাদের মা কামরুন নাহার নিজের কাঁধে নিয়ে আমাদের বড় করে তুলেন। নিজের সম্পর্কে বলতে সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এস এস সি এবং ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করেছি। স্কুল এ থাকতে ২০০৯ সালে গ্রেগরীয়ান সাইন্স ক্লাবের প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে স্কুলে প্রথমবারের মতো ইন্টার স্কুল বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করি। কলেজে থাকতে ইমপিরিয়াল সাইন্স ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি এবং ৫ম মেট্রোপলিটন বিজ্ঞান মেলার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সেই সঙ্গে ইমপিরিয়াল তার্কিক সভা এবং কলেজের অন্যন্য সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। মেডিকেল কলেজে প্রথম ও দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেছি। ডিপ্রজন্ম- রক্তের যোগান কিভাবে করেন, পুরো প্রক্রিয়াটা জানান- এসআই প্রবাল- সন্ধানীতে আমাদের কাছে কেউ রক্তের জন্য যোগাযোগ করলে আমরা আমাদের ইউনিট এ যারা রক্তদাতাদের যেই তালিকা থাকে তা থেকে রক্তের গ্রুপ মিলিয়ে রক্তদাতা খুঁজে বের করি। যদি কাউকে পেয়ে যাই সেই ক্ষেত্রে রক্তদাতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করি। যদি কাউকে পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের রেজিস্ট্রেশন খাতা অনুসরণ করি। সেখানে যারা রক্তদানের যোগ্য তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি, এছাড়া সন্ধানীতে বিনিময়ের মাধ্যমে রক্ত বিতরণ করা হয় অর্থাৎ কারও যদি বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে ও পজেটিভ রক্তের কোন ডোনার থাকে তিনি সেই রক্তদান করে সন্ধানী থেকে রক্ত নিতে পারবেন। এর ফলে যে ব্যক্তি কখনও রক্তদান করেনি উনিও নিজের আত্মীয়র প্রয়োজনে একবার হলেও রক্তদান করবে। এতে উনার মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মানসিকতাও গড়ে উঠবে। যারা সন্ধানীতে স্বেচ্ছায় রক্তদান করবেন তাদের সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ থেকে একটি অভিন্ন ডোনার কার্ড বিতরণ করা হয়। এই কার্ড দিয়ে উনি উনার নিজের প্রয়োজনে বাংলাদেশের যে কোন ইউনিট থেকে যত ব্যাগ রক্তদান করেছেন তত ব্যাগ রক্ত বিনা শর্তে পাবেন। ডিপ্রজন্ম- সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণী আপনাদের সহযোগীতা কতটুকু পায়? কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীও রক্তের দরকারে ফেসবুকে পোস্ট করতে পারে, কিন্তু নিম্নবিত্তরা জানেই না হয়তো আপনাদের সম্পর্কে- এসআই প্রবাল- সন্ধানীর সাহায্যের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ আবেদন করতে পারবেন। প্রত্যেকটি ইউনিটের যারা রক্তযোগানের জন্য কাজ করছে তাদের ফোন নম্বর সেসব হাসপাতালে দেয়া আছে। যাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে তারা খুব সহজেই ওই নম্বর এর মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। আমরা সম্পূর্ণ ফ্রিতে ব্লাড দেবার নিয়মে বিশ্বাসী। আমরা প্রত্যেকদিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি ফোন পেয়ে থাকি। এর বেশিরভাগ ফোন এসে থাকে অনেক অসহায় মানুষের কাছ থেকে। সন্ধানীয়ানরা সবসময় চেষ্টা করে প্রয়োজনীয় রক্ত যোগাড় করে দিতে। কিন্তু সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও আমাদের পক্ষে যোগাড় করে সম্ভব হয়ে উঠে না। ডিপ্রজন্ম - সন্ধানীর কার্যক্রমে সামাজিক দায়বদ্ধতা বেশি বলে মানুষের মুখে শোনা যায়, মূল্যায়ন করবেন যেভাবে? এস আই প্রবাল- অবশ্যই আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। সন্ধানীয়ানরা সবাই মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্রছাত্রী। আমাদের কঠিন কঠিন পড়ার ফাঁকে এই সমাজ ও দেশের মানুষের জন্য স্বেচ্ছাসেবী কাজকর্ম করাটা খুবই কষ্টের। কিন্তু সবার মধ্যেই কিছু করার তাড়না আছে। সেই তাড়না থেকেই সন্ধানীয়ানরা সামাজিক দায়বদ্ধতা মাথায় রেখেই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছে। আমরা ছাত্রছাত্রী নির্ভর সংগঠন হওয়ার কারণে আমরা যেমন আর্থিক সঙ্কটে ভুগছি ঠিক তেমনি কিছু অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা নিয়েও আমাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবার কাছে অনুরোধ থাকবে, সন্ধানীর উন্নতির জন্য এগিয়ে আসার জন্য এবং সকল ব্যক্তিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থের উপরে সন্ধানীকে রাখার জন্য অনুরোধ করব। ডিপ্রজন্ম- সারাদেশে অনেক তরুণরাই এ ধরনের সংগঠন খুলছে, এ হিসেবে বলা যায় সন্ধানী পথিকৃৎ। তরুণদের যেভাবে সহযোগিতা করেন অথবা কোন পরামর্শ- এস আই প্রবাল- অবশ্যই সমাজের জন্য এটা খুব পজিটিভ একটা দিক। যে কোন সংগঠন এর জন্য আমার প্রথম নির্দেশনা থাকবে আপনারা নিজেদের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। যত বাঁধাই আসুক আপনারা আপনাদের লক্ষ্যে উপবিষ্ট হবেন সেভাবেই নিজেদের তৈরি করুন, দেখবেন আপনাদের উন্নয়ন কেউ আটকে রাখতে পারবে না। সেই সঙ্গে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে তুলুন। এক্ষেত্রে সন্ধানীয়ানদের কাছে পরামর্শ নিতে পারেন। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সন্ধানী কিভাবে ৪১ বছর টিকে আছে তা সবার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সর্বোপরি চেষ্টা করবেন, এই দেশ আর আমাদের আশপাশের সমাজের জন্য কিছু করতে, মানবতার জন্য করতে, তাহলে দেখবেন সফলতা আসবেই। ডিপ্রজন্ম- রক্তদান একটি মহৎ কাজ, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের জন্য পরামর্শ বা রক্তদানে আপনার কোন মতামত থাকলে বলুন- এস আই প্রবাল- স্বেচ্ছায় রক্তদান একটি মহৎ কাজ। দেশের কত মানুষ আজ রক্তের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না বা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে তার কোন পরিমাপ করা যায় না। রক্তদান করলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। আমাদের শরীরের রক্তের লোহিত কণিকা ১২০ দিন অর্থাৎ ৪ মাস অন্তর নষ্ট হয়ে প্রসাব, ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। আপনি যদি সেই রক্ত চার মাস পরপর কোন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য দান করেন তাহলে তা হবে অন্যতম মানবসেবা। এছাড়াও রক্তদান করলে আপনি বিনামূল্যে ৫টি টেস্টের ফলাফল পেয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে যে কোন সময় আপনার রোগ খুব সহজেই ধরা পড়ে যাবে। একবার ভাবুন, একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী যার ৭-৮ বছর বয়স হতে প্রতি মাসে একবার করে রক্ত লাগছে অথবা একজন প্রসূতি মহিলা যেক্ষেত্রে কিনা দুটি জীবন নির্ভর করছে আপনার রক্তদানের ওপর। আপনি কি সেক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বেন? নাকি সৃষ্টিকর্তার কৃপায় জীবন বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসবেন? আসুন সুস্থ থাকলে, সময় হলে নিয়মিত রক্তদান করি। সেইসঙ্গে মরণোত্তর চক্ষুদানের মাধ্যমে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করি।
×