ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদিনে তাজিয়া মিছিল ও বিজয়া দশমী ঘিরে কড়া নিরাপত্তা বলয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

একদিনে তাজিয়া মিছিল ও বিজয়া দশমী ঘিরে কড়া নিরাপত্তা বলয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী তাজিয়া মিছিল ও সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব কেন্দ্র করে সারাদেশে থাকছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর একই দিনে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে সবচেয়ে বড় তাজিয়া মিছিল এবং বিজয়া দশমী হতে যাচ্ছে। ২০১৫ সালেও একই দিনে তাজিয়া মিছিল ও বিজয়া দশমী অনুষ্ঠানের দিন পুরনো ঢাকার হোসেনী দালানের ইমামবাড়ায় ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গী হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এবারও যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিব্রত সরকারকে আরও বেকায়দায় ফেলতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর তাজিয়া মিছিলে ও বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানের দিনে দেশে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নাশকতা চালানোর নেপথ্যে কাজ করছে স্বাধীনতা বিরোধী ও তাদের দোসর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হোসেনী দালান ও পুজোম-প এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে কড়া নিরাপত্তা বলয়। বসানো হয়েছে শত শত সিসি ক্যামেরা। বসেছে ওয়াচ টাওয়ার। আর্চওয়ে মেটালডিটেক্টর। মোতায়েন করা হয়েছে পর্যাপ্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা। নিরাপত্তার স্বার্থে তাজিয়া মিছিলের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বুধবার সরেজমিনে পুরনো ঢাকার হোসেনী দালান এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, চার শ’ বছরের পুরনো ঐহিত্যবাহী ইমামবাড়ায় শত শত মানুষের ভিড়। অনেকটা তিল ধারণের জায়গা নেই। গতবছর ইমামবাড়ার মূল গেটে দোকান ছিল। এবার মহরম মাসের শুরু থেকে তা তুলে দেয়া হয়েছে। হোসেনী দালানের চারদিকে আধাকিলোমিটারজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা বলয়। বসানো হয়েছে পুলিশ ও র্যাবের অসংখ্য চেকপোস্ট। চানখারপুল থেকে শুরু করে পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ভারি যানবাহন যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইমামবাড়ার চারদিকের দেয়ালের ওপর পাঁচ ফুট কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। বসেছে তিনটি কন্ট্রোল রুমÑএকটি পুলিশ, একটি র্যাব ও অপরটি ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে বসিয়েছে। মূল গেটে পুলিশের তরফ থেকে ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। চারদিকে মোতায়েন করা হয়েছে প্রচুর পুলিশ আর র্যাব। চারদিকে সার্চ লাইট বসিয়ে সর্বক্ষণিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একদিক দিয়ে জিয়ারতকারীরা প্রবেশ করবেন। অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যাবেন। ওয়ানওয়ে পদ্ধতিতে জিয়ারতকারীদের চেকপোস্টে তল্লাশি শেষে প্রবেশ করতে হবে। আশপাশের বাড়িতে আগত অতিথিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। আশুরার আগে নতুন ভাড়াটিয়াদের বাড়িতে ওঠার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আশুরার একদিন আগ থেকেই আশপাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ইমামবাড়ার স্বেচ্ছাসেবক ফারহান জানান, ইমামবাড়ার নিজস্ব ২শ’ স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। তাদের তরফ থেকে ২৩টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রতিদিনই তাজিয়া মিছিল বের হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা তিন দিন তাজিয়া মিছিল হবে। এবার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকে প্রতিবারেরমতো আসা তাজিয়া মিছিলকে ইমামবাড়ায় না আসার জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিলের ওপর এবার কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিল শুধু ইমামবাড়া থেকে বের হয়ে চানখারপুল, বেগমবাজার ও চকবাজার হয়ে আবার ইমামবাড়ায় প্রবেশ করবে। এর বাইরে তাজিয়া মিছিল না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বৈঠকের পরই নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এমন বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ৮ মহরম ইমামবাড়া থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তাজিয়া মিছিল বের হয়ে নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে ঘুরে রাত নটায় ইমামবাড়ায় গিয়ে শেষ হবে। পরদিন সকাল নয়টায় তাজিয়া মিছিল বের হয়ে দুপুর বারোটায় শেষ হবে। সর্বশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর ১০ মহরম সর্বশেষ তাজিয়া মিছিলটি বের হবে সকাল দশটায়। আর শেষ করতে হবে দুপুর দেড়টার মধ্যে। মিছিলে বহন করা নিশানের উচ্চতা ১২ ফুটের বেশি হবে না। মিছিলে কোন প্রকার ধারালো ছুরি, চাকু বহন করা যাবে না। মিছিলে আগুন ও লাঠি খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের তাজিয়া মিছিলকে ঘিরেও থাকছে কড়া নিরাপত্তা। নির্দিষ্ট রাস্তায় মিছিল করতে বলা হয়েছে। ২০১৫ সালের তাজিয়া মিছিলে হামলার অভিজ্ঞতা থেকেই বিধি-নিষেধ জারি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাত প্রায় আড়াইটার দিকে পুরনো ঢাকার হোসেনী দালানের ইমামবাড়ার তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় জামাল উদ্দিন (৫৫) ও মোহাম্মদ শানজু (১৫) নামে দুজন নিহত হয়। আহত হয় শতাধিক। হামলায় ব্যবহৃত হয় হামলাকারীদের তৈরি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেড। যার মধ্যে ৩টি বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থল থেকে অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার হয় দুটি। হোসেনী দালানে বোমা হামলার আগের রাতে ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীর আমিনবাজারে চেকপোস্টে তল্লাশিকালে ছুরিকাঘাতে দারুস সালাম থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এসএসআই) ইব্রাহিম মোল্লা হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পালানোর সময় বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্র শিবিরের সাথী মাসুদ রানা গ্রেফতার হয়। মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলাসহ নানা ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাসুদ রানার বরাত দিয়ে ডিবি সূত্র জানায়, পুলিশ কর্মকর্তাকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি হিরণ ওরফে কামাল ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। কামালের সঙ্গে সেও কামরাঙ্গীরচরে যাচ্ছিল। তাদের ব্যাগে নাশকতা চালানোর নানা সরঞ্জাম ছিল। দলীয় নির্দেশে কামাল পুলিশকে হত্যা করে। মাসুদ রানার তথ্যমতে ওই রাতেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের একটি বাড়ি থেকে ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেডসহ জামায়াত কর্মী আব্দুল আজিজ মিয়া ও তার দুই ছেলে ছাত্র শিবির কর্মী ফজলে রাব্বী ও রাকিব হাসানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলার ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত ২টি হ্যান্ডগ্রেনেড আর কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধারকৃত ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেড হুবহু এক ও অভিন্ন। এরপর মাসুদ রানার তথ্যমতে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয় ১০ জন। এরা হচ্ছে কবির হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক, আরমান ওরফে মনির, জাহিদ হাসান ওরফে মোসাদ, রুবেল ওরফে সজিব। এ চারজন এবং মাসুদ রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এদের তথ্যমতে গ্রেফতার হয় চাঁন মিয়া, ওমর ফারুক ওরফে মানিক, মোঃ শাহজালাল, আবু সাঈদ ও হাফেজ ক্বারী আহসান উল্লাহ মাহমুদ। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মোতাবেক অভিযানকালে হোসেনী দালানে বোমা হামলায় জড়িত জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আলবানি ওরফে হোজ্জা ভাই ওরফে মেম্বার ভাই ওরফে শাহাদত ওরফে মাহফুজ, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা জেএমবির আমির আব্দুল্লাহ ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান এবং কামাল ওরফে প্রকাশ ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মারা যায়। গ্রেফতারকৃত ও নিহতরা এক সময় ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। সূত্র আরও জানায়, হামলায় জড়িত জঙ্গীরা সারা পৃথিবীতে তোলপাড় সৃষ্টি করতে ২ মাস আগে দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশে আইএসের মতো জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা থাকার বিষয়টি সারা দুনিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য করতে, আইএসের কাছ থেকে সমর্থন পেতে এবং দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রেখে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হামলাটি করে।
×