ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

অপার সম্ভাবনার পর্যটন শিল্প যে কারণে পিছিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অপার সম্ভাবনার পর্যটন শিল্প যে কারণে পিছিয়ে

আজাদ সুলায়মান ॥ তাজমহল দেখে চেনা যায় ভারত। এভারেস্ট দেখে নেপাল। আইফেল টাওয়ার দেখে প্যারিস আর লিবার্টি স্ট্যাচু দেখে আমেরিকা। কিন্তু বাংলাদেশকে চেনার উপায় কি? শাপলা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জাতীয় সংসদ, সুন্দরবন নাকি কক্সবাজার দেখে? স্বাধীনতার পর গত পয়তাল্লিশ বছরে আমরা এখনও ঠিক করতে পারিনি বাংলাদেশের আইকন । বিদেশী পর্যটকরা আসার পর এমন সব প্রশ্নের উত্তর কোন গাইডের কাছ থেকে মেলে না। একটা এভারেস্ট দেখিয়ে জাতীয় বাজেটের ৬০ শতাংশ অর্জন করে নেপাল। শুধু তাজমহল থেকেই আসে ভারতের জাতীয় আয়ের ১২ শতাংশ। কয়েকটি সাধারণ মানের সী বিচ দিয়ে যে অর্থ আয় করে থাইল্যান্ড তা জাতীয় আয়ের ৪০ ভাগ। এ তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কি? পৃথিবীর র্দীর্ঘতম অপূর্ব সমুদ্র সৈকত থেকে কত আয় করতে পারছে বাংলাদেশ? খুবই নগণ্য। মাত্র ৪ দশমিক ২ যা উল্লেখ করার মতো নয়। আর পর্যটনশিল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিসংখ্যান যদি তুলনা করা হয় তার চিত্র আর অবিশ্বাস্য। ভারতে চলতি অর্থবছরে পর্যটন খাতের বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৮৪০ কোটি ৭৭ লাখ রুপী, নেপালে ১৩৭২ কোটি রুপী, মালয়েশিয়ায় ২৬০ কোটি রিংগিত, মালদ্বীপে ২৬৭০ কোটি রুফিয়া, সিঙ্গাপুরে ২৪ হাজার ১০০ কোটি সিঙ্গাপুরী ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ হাজার কোটি রুপিয়া, থাইল্যান্ডে ৯৪০ কোটি বাথ। বাংলাদেশে এই খাতে চলতি বছরের বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। বাজেট দিয়ে যদি পর্যটন খাতের অবস্থা নির্ণয় করা হয়Ñ তাহলে কতটা দৈন্যদশা ও অবহেলার চিত্র এটি তা বোঝার জন্য কোন বিশেষজ্ঞের দরকার পড়ে না। পর্যটনশিল্পের আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কতো পিছিয়ে তা এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়। পর্যটন খাতের এমন দৈন্যদশায় আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। যেখানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন কর্পোরেশন দায়িত্ব পালন করছে পোস্ট বাক্স হিসেবে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান গতানুগতিক সেই চলছে সরকারের কিছু নির্দেশনা পালনে। দেশী-বিদেশী কত পর্যটক বছরে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে, কত পর্যটকের সেবায় এদের অবদান রয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই এদের কাছে। বছরে একবার এই দিবসটি পালন করা হয় রাজধানীতে কয়েকটি র‌্যালি বের করা, সভা- সিম্পোজিয়াম, সেমিনারে বক্তৃতা আর টেলিভিশনের কয়েকটি টকশোর মতো গৎ বাঁধা রুটিন ওয়ার্কে। অন্যবারের মতো এবারও সেই একই চিত্র। আজ বুধবার সকালে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে মৎস্য ভবনের সামনে একটি র‌্যালি বের করা হবে, তারপর টিএসসিতে এ সংক্রান্ত আলোচনা সভা, বিকেলে সাংবাদিকদের উদ্যোগে রবীন্দ্র সরোবরে একটা ট্যুরিজম ফেস্ট ও কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে। এখানে থাকবেন বিমান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর আগামী দুই দিন রাজধানীতে রয়েছে বুড়িগঙ্গার তীরে ইতিহাস ও ঐহিত্য এবং রন্ধন শিল্পীদের লাইভ অনুষ্ঠান। এই হচ্ছে এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের কর্মসূচী। এবারের কর্মসূচীতে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও কার্যকর মূলত পর্যটন রয়ে গেছে সেই পুরনো বৃত্তেই। প্রতিবারই সরকারপ্রধান, মন্ত্রী আমলা আর কজন ট্যুর অপারেটরের মুখে উচ্চারিত হয় একই বাণীÑপর্যটনশিল্পের বিকাশের সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি জড়িত। এ সেক্টরকে আরও উন্নত করতে হবে। আগামী বাজেটে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। ফি বছর বরাদ্দের দাবি তোলেন মন্ত্রীরা। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বিকশিত হচ্ছে না আধুনিক বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতির এই খাত। পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এই খাত নিয়ে উদ্যোক্তারাও যেমন হতাশ, তেমনি বিশেষজ্ঞরাও দেখছেন না কোন আশার আলো। তাদের মতে, একটি দেশের পর্যটনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ওই দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান, বস্তু, স্থাপত্যশিল্প কিংবা প্রাকৃতিক কোন দৃৃশ্য। প্রাচীন সভ্য ও সমৃদ্ধ দেশ প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের যেমন শিল্পমূল্য রয়েছে তেমনি গরিব দেশ নেপালের এভারেস্টের দামও তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। ভারতের তাজমহল যেমন সপ্তামাশ্চার্য হিসেবে ভুবনখ্যাত, তেমনি বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিংবা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতও জগদ্বিখ্যাত। শিল্প মূল্যের বিচারে এগুলো স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। কেন বাংলাদেশ আজও একটি আইকন নির্বাচিত করতে পারেনি। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি স্কোয়াড্রন লিডার (অব) এস এম মতিনের মূল্যায়ন অভিমত ‘পর্যটন কিভাবে এগুবে? বাংলাদেশের আইকন কি হবে সেটাই ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না। এ দেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবন, সমুদ্র সৈকত ও জাতীয় সংসদ ভবনের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এগুলোর কদর রয়েছে। অথচ এগুলোকে পুঁজি করা যাচ্ছে না। জাতি এখানেই তো পিছিয়ে রয়েছে অন্য দেশের তুলনায় যোজন যোজন দূরে। অতীতে হয়নি, কারণ কেউ দায়িত্ব নেননি। যারা পর্যটন নিয়ে গতানুগতিক কাজ করেন তারা কতটুকুই বা বোঝেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, পর্যটন যে একটা শিল্পÑএটাই প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। যতদিন পর্যন্ত পর্যটন খাতকে একটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা থেকে যাবে অবহেলিত। বিদেশীরা এখানে আসার ইচ্ছে থাকলেও তারা সাহস পান না। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবন যেতে কত সময় লাগে নদী কিংবা সড়কপথে তা শুনেই শিউরে ওঠেন। একই অবস্থা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের। পৃথিবীর দীর্ঘতম এ সৈকতপ্রেমীদের জন্য নেই কোন আলাদা বিশেষায়িত জোন। নেই কোন পানশালা, ডিস্কো কাভার, ক্যাসিনো কিংবা অন্যকিছু। বিদেশীরা এখানে কি করতে আসবেন? এস এম মতিন বলেন, আগে ঠিক করতে হবে আইকন। আমার মতে, জাতীয় সংসদ ভবনকে সর্বসম্মতভাবে আইকন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। এটি পৃথিবীর অন্যতম স্থাপত্যশিল্প হিসেবে দেশ বিদেশে স্বীকৃত। তারপর গড়তে হবে অবকাঠামো, বিশেষায়িত ট্যুরিস্ট জোন ও সর্বোপরি নিরাপদ পরিবেশ। এ জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও অর্থা বরাদ্দ। বছরে মাত্র বিশ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে দেশের পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটানোর স্বপ্ন যারা দেখেন তারা এখনও বোকার স্বর্গেই রয়ে গেছেন। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় বলেন, বিশ্ব পর্যটন দিবস এলে মানুষের মনে দেখা দেয় সামান্য কৌতূহল। আর বাকি সারা বছর সরকারী-বেসরকারী সবাই যেন ভুলেই যায় এটি একটি শিল্প। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশে একটি বিশেষ ট্যুরিস্ট জোন গড়া সম্ভব হয়নি। কক্সবাজার গিয়ে কোন বিদেশী বিকিনি পরে পানিতে নামতে পাওে না, প্রকাশ্যে সূর্য¯œানে একটি বিয়ার হাতে নিতে পারে না, রাতে ডিস্কো বারে গিয়ে নাচতে পারে না, ক্যাসিনোতে গিয়ে বাজি ধরতে পাওে না। তাহলে কি করতে বিদেশীরা এখানে আসবেন? তারপরও আমি বলব বিপুল সম্ভাবনার দেশ এই বাংলাদেশ। কক্সবাজারের দক্ষিণে ইনানী বিচ কিংবা শাহপরী দ্বীপে বিদেশী ট্যুরিস্টদের জন্য গড়ে তোলা যেতে পারে সংরক্ষিত বিশেষ কেন্দ্র। এ জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দরকার নেই। সরকারের সদিচ্ছা ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলেই সম্ভব। এসব বিষয়ে কী বলছেন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশান? মঙ্গলবার মহাখালীতে এ প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতরে গিয়ে দেখা যায়, আজকের দিবসটি পালনের কিছু কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রস্তুতি। প্রতিষ্ঠানটিতে ন্যাশনাল হোটেল এ্যান্ড ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিজের অধ্যক্ষ ও মহাব্যবস্থাপক পারভেজ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অতীতের চেয়ে এবারের প্রস্তুতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এবার টেকসই পর্যটন ও উন্নয়নের হাতিয়ার প্রতিপাদ্য নিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীর বাসভবনে জাতীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছে দিবসটি পালনের একগুচ্ছ কর্মসূচী। যা চলবে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পর্যটন খাত যখন নতুন মোড় নিচ্ছিল তখনই হত্যা করা হয়েছে জাপানী নাগরিক হোশিও কুনিকে, তারপর হলি আর্টিজানের হামলা। এতে পর্যটন খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তারপরও এগিয়ে চলছে আশানুরূপ। বর্তমানে এই খাতে সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন টাকা। গত বছর ডমেস্টিক ট্যুরিস্টের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ আর বিদেশী ৬ লাখ। পারভেজ চৌধুরী জানান, পর্যটন কর্পোরেশন বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিপিপি মডেলে কক্সবাজারের শৈবালে পাঁচতারকা বিশিষ্ট রিসোর্ট নির্মাণ, উপলে বিশাল সিনে কমপ্লেক্স নির্মাণ, মংলায় একটি অত্যাধুনিক হোটেল নির্মাণ, আগারগাঁওয়ে সদর দফতর নির্মাণসহ আরও কয়েকটি অবকাঠামো। এদিকে আজকের দিবসকে সামনে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, এ বারের দিবসটিতে ভিন্ন আঙ্গিক রয়েছে। সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত এক কংগ্রেসে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন সংগঠনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে।
×