ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএটিবির ভ্যাট ফাঁকির ঝামেলা নিষ্পত্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড়

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিএটিবির ভ্যাট ফাঁকির ঝামেলা নিষ্পত্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে ভ্যাট ফাঁকির ঝামেলা মেটাতে ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশের (বিএটিবি) একটি উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি মীমাংসায় ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনও লবিং চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। ঘটনাটি প্রথম প্রকাশ করে ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান। এ নিয়ে পত্রিকাটি সমালোচনা করেছে। পরে বাংলাদেশেও গণমাধ্যমে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। গত জুলাইয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিটকে লেখা এক চিঠিতে বিএটিবি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতিতে ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির বিতর্ক অবসানের আগ্রহ প্রকাশ করে। বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটির অনুরোধে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনও গত মাসে অর্থমন্ত্রীকে এ বিষয়ে একটি চিঠি লিখেছে। চিঠিতে বলা হয়, আমরা বুঝতে পারছি যে আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে এনবিআর যাতে আইন মন্ত্রণালয় ও এ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করেন সে জন্য আপনি চেষ্টা করছেন। কোন কারণে ওসব মিটিং হয়নি। কোন মামলা ছাড়াই বিরোধ নিষ্পন্ন করার পদ্ধতি হচ্ছে এডিআর। এডিআর সাধারণত কম আনুষ্ঠানিক, কম ব্যয়বহুল এবং সময়ও কম লাগে। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী তা এনবিআরে পাঠিয়ে দেন। এনবিআর অবশ্য বলেছে, যতদিন মামলা সুপ্রীমকোর্টে মুলতবি থাকবে ততদিন বিষয়টি নিয়ে কিছু করার নেই। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) কমিশনার (ভ্যাট) মতিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আদালতের বাইরে মীমাংসা এখন সম্ভব নয়। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানও বলেন, বিষয়টি বিচারাধীন এবং আইন-আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন বিএটিবি একটি ভাল করদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর তারা সরকারী কোষাগারে মোটা অঙ্কের রাজস্ব জমা দেয়। ভ্যাট নিয়ে এই বিতর্ক শুরু হয় ২০০৯ সালে যখন বিএটিবি জাতীয় বাজেটে নির্ধারিত মূল্যান্তর থেকে একধাপ নিচের স্তরে নামিয়ে এনে ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি করে। ব্র্যান্ড দুটির মূল্য কমিয়ে ফেলায় এ দুটি ব্র্যান্ড থেকে সরকারের রাজস্বও কমে যায়। এনবিআর হিসেব করে দেখতে পায় ব্র্যান্ড দুটির মূল্য না কমিয়ে আগের স্তরে রাখলে কোম্পানির কাছ থেকে ২০০৯-১০ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত অতিরিক্ত ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পাওয়া যেত। দাম কমানোর ফলে এই রাজস্ব কম পেয়েছে এনবিআর। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০১৩ সালের ২৭ নবেম্বর এই অর্থ দাবি করে বিএটিবিকে নোটিস দেয়। যেখানে এনবিআর অভিযোগ করে বলে, মিথ্যা ঘোষণা ও তথ্য দিয়ে সরকারকে এই পরিমাণ রাজস্ব কম দিয়েছে বিএটিবি। যেখানে ব্র্যান্ড দুটির সিগারেট মধ্যবর্তী স্তরে বিক্রি করার কথা সেখানে বিএটিবি বিক্রি করেছে নিম্ন মূল্যস্তরে। এনবিআরের দাবির প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে বিএটিবি। হাইকোর্ট রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে রায় দিয়ে এই টাকা পরিশোধ করতে বলে। হাইকোর্টে মামলায় হেরে যাওয়ার পর বিএটিবি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে চিঠি লিখে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করে। এমনকি বিএটিবির মূল শেয়ারহোল্ডার ব্রিটিশ কোম্পানি রালি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনে’ মামলা দায়ের করবে বলে হুমকি দেয়। বিএটিবির চিঠিতে বলা হয়, এনবিআর যে ১৯২৪ কোটি টাকা দাবি করছে, তা কোম্পানিটির এক বছরের কর পরবর্তী মুনাফার তিনগুণেরও বেশি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সব কর্মকর্তার সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় বিএটিবি বিচার পেতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাইকোর্টের রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে রায়ের বিপক্ষে আপীল করে বিএটিবি; যা এখনও অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। তাই এ ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে সমঝোতার সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি পাঠিয়ে সমঝোতা বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব করেছে ব্রিটিশ হাইকমিশন। চিঠিতে হাইকমিশনার লিখেছে, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বেও একাধিকবার আলোচনা করেছি। আমি আশাবাদী, আপনার অফিস বিষয়টি সমাধানে আন্তরিক। আপনি হয়ত জানবেন, ২০০৯ থেকে ১৩ সাল পর্যন্ত সিগারেট বিক্রির পুরনো ঘটনায় এনবিআর বিএটিবির কাছে ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট দাবি করেছে। বিষয়টি ২০১৫ সালের পর হাইকমিশনের নজরে আনা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এ বিষয়ে আইনগত মতামত দিয়েছে। সিগারেট হলো কনজ্যুমার পণ্য, যার দামের মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু সিগারেট বিক্রির সময়ই তা পরিশোধ করা হয়, তাই পূর্ববর্তী ঘটনার প্রেক্ষাপটে উৎপাদকের (বিএটিবি) ভ্যাট দাবি করার কোন সুযোগ ছিল না। হাইকমিশনকে লেখা চিঠির অনুলিপি অর্থমন্ত্রীকেও দিয়েছিল বিএটিবি। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন, আদালতের দিকনির্দেশনা মেনে নতুন দাবি তাদের কাছে পাঠাতে হবে। তামাক কোম্পানির পক্ষে হাইকমিশনারের চেষ্টা-তদবিরের সমালোচনা করে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) পক্ষে দেশটির অর্থমন্ত্রীর কাছে লবিং করেছিলেন। ২০১২ সালে পানামায় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বিএটিবির পক্ষে স্ক্যান্ডালে জড়ানোর পর ব্রিটিশ বৈদেশিক অফিস থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, স্থানীয় কোন নীতি যদি ব্রিটিশ তামাক কোম্পানির জন্য বৈষম্য সৃষ্টি না করে তাহলে কোন কর্মকর্তা তামাক কোম্পানির পক্ষে কাজ করতে পারবে না। বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহ দেয়া কিংবা ব্যবসায় সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও কর্মকর্তারা তামাক কোম্পানির পক্ষে কোন কাজ করতে পারবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নীতিমালাতেও কোন তামাক কোম্পানির পক্ষে সরকারের সহায়তা না করার কথা বলা আছে, তাতে যুক্তরাজ্যও স্বাক্ষর করেছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের এমন হস্তক্ষেপ যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশে তামাক ও দুর্নীতি বিরোধী সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। অর্থমন্ত্রীকে লেখা হাইকমিশন ও বিএটিবির চিঠির তথ্যানুযায়ী, ১০৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে সিগারেট উৎপাদক ও বিপণনকারী কোম্পানিটি। বিএটিবি ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটিতে সরকারসহ বাংলাদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ১৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির ৭২.৯১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ব্রিটেনের রালি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। গত বছর কোম্পানিটি একক কোম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছে।
×