ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন বাড়লেও ইলিশের দাম কমছে না

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

 উৎপাদন বাড়লেও ইলিশের দাম কমছে না

এমদাদুল হক তুহিন ॥ দেশে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও দাম কমছে না। অধিকাংশ ক্রেতাই বলছেন গত বছরের চেয়ে এবার ইলিশের দাম বেশি। ২০১৬ সালে ঢাকার অলিগলিতে ইলিশের ভরপুর আমদানি লক্ষ্য করা গেলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। ইলিশ আছে, তবে তা পূর্বের বছরের মতো নয়। বলা যেতে পারে, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে গত বছরই ইলিশের দাম ছিল সবচেয়ে কম। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সর্বশেষ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ আর বছর ব্যবধানে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় এক লাখ টন। সর্বশেষ অর্থবছরে চার লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হলেও চলতি অর্থবছরে তা পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে চার হাজার টাকা হালিতে আর ৮০০ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি পিস ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা কেজিতে। একই ওজনের ইলিশ হালিতে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকায়। তথ্য থেকে জানা গেছে, গত বছর আকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২২০০ থেকে ৩০০০ টাকা হালিতে। এক্ষেত্রে বছর ব্যবধানে বড় ইলিশের হালিপ্রতি দাম বেড়েছে এক হাজার থেকে ১৮০০ টাকা। ছোট ইলিশের ক্ষেত্রেও দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন শ’ টাকা বেড়েছে। তবে বিক্রেতারা বলছেন, ইলিশের দাম খুব একটা বাড়েনি। এবার দাম পূর্বের বছরের মতোই। বৃহস্পতিবার দুপুরে কাওরানবাজারের মাছের বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বিভিন্ন আকারের ইলিশ মিলছে। তবে এক কেজি ওজনের ইলিশই সবচেয়ে বড়। বড় আকারের এই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে চার হাজার টাকা হালিতে। এরচেয়ে একটু ছোট আকারের ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। কাওরানবাজারের মাছ বিক্রেতা শিপন জানান, ৯৫০ গ্রামের প্রতি পিস ইলিশের দাম পড়ছে ৮০০ টাকা। তার মতে, এবার ইলিশের দাম বেশি নয়, অন্যান্য বছরের মতোই। তবে একই বাজারে ইলিশ কিনতে আসা তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা হাসমত বলেন, এক কেজি ওজনের ইলিশ গত বছর হালিতে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হলেও একই ওজনের ইলিশ এবার ৪০০০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে। এতেই স্পষ্ট ইলিশের দাম এবার গত বছরের চেয়ে বেশি। একই ধরনের কথা বলেন রাজধানীর বাসিন্দা সুবর্ণ আদিত্যও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পূর্বের কয়েক বছরের তুলনায় ইলিশের দাম কমলেও বর্তমানে বাজারে ইলিশের যে দাম, তা গত বছরের চেয়ে বেশি। এদিকে, নাখালপাড়া প্রাইমারী স্কুলের সামনে ফেরি করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে মোঃ সাইদুলকে। তিনি ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি করছেন ৫৫০ টাকা কেজিতে। জানালেন, একই ওজনের ইলিশ হালিতে বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকায়। নাখালপাড়ার ৮নং গলিতে ফেরি করে মাছ বিক্রি করে এমন এক বিক্রেতা এক কেজি ওজনের ইলিশ হালিপ্রতি চার হাজার টাকা হাঁকছেন। ফার্মগেট, বাংলামোটর ও শাহবাগেও একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশে ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে বিস্তৃত হয়েছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওড়েও এ বছর ইলিশ পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশের আশার আলো হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো এক লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাাঁড়ায় তিন লাখ ৯৫ হাজার টন। আর সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে চার লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও তুলনামূলকভাবে দাম কমছে না। তবে ইলিশ এখন সবার হাতের নাগালে। খেটে খাওয়া মানুষের আহারেও মেন্যু হচ্ছে এক সময়ের অধরা ইলিশ। বর্তমানে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বছরে একবার হলেও ইলিশ খাচ্ছেন। ঢাকায় পাঁচ বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন গাইবান্ধার বাসিন্দা মোঃ জেন্নাত। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, উৎসব-আনন্দে আমরাও ইলিশ খাই। তবে অনেক সময় বাধ্য হয়ে। ঈদের পর সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। বাসায় মেহমান এসেছে। তখন বাধ্য হয়ে প্রায় হাফ কেজি ওজনের দুটি ইলিশ কিনেছি প্রায় এক হাজার টাকায়। তিনিও জানালেন, গত বছরের একই সময়ে ইলিশের দাম আরও কম ছিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে ইলিশ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেছেন, ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য জাটকা নিধনই দায়ী। পরে জাটকা নিধন বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে জাটকা নিধন একেবারে থেমে নেই। খোদ রাজধানীতেই ১০ ইঞ্চির নিচে ইলিশের দেখা মেলে। বৃহস্পতিবার নাখালপাড়ার প্রাইমারী স্কুলের সামনে এক মাছ বিক্রিতাকে ৮ ইঞ্চি আকারের ছোট ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে। সামগ্রিক প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে ইলিশের দাম কমছে না এটা ঠিক নয়। হয়ত প্রত্যাশা অনুযায়ী কমছে না এটা ঠিক। বর্তমানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, এটা এক অর্থে কমই। তিনি বলেন, তবে মাছের বাজারে কেন ইলিশ আসছে না তা মার্কেটিং করার দায়িত্ব মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের। হয়ত কোথাও কোথাও স্টক হয়ে যাচ্ছে, ফলে বাজারে ইলিশ আসছে না। তিনি বলেন, দেশে প্রতি বছরই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে চার লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। চলতি বছরে তা পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
×