ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বানভাসিদের জীবনকথা ॥ সরেজমিন প্রতিবেদন

তিস্তাই বাঁচায় আবার তিস্তাই মারে

প্রকাশিত: ০৫:০২, ২৮ আগস্ট ২০১৭

তিস্তাই বাঁচায় আবার তিস্তাই মারে

ওয়াজেদ হীরা, লালমনিরহাট থেকে ফিরে ॥ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীর নাম ‘তিস্তা’। ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদী। তিস্তা পাড়ের মানুষের কাছে এই নদীর পানি কখনও স্বপ্ন আবার এই কখনও চোখের জল হয়ে ভাসায়। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বিস্তীর্ণ বালুচরে চাষাবাদ হলেও পানির অভাবে ফলন ভাল হয় না। আবার বর্ষায় এই তিস্তায় আসা বানে ভাসে তীরবর্তী আশপাশের সকল মানুষ। তিস্তা পাড়ের মানুষ বলছে এই তিস্তা নদীই এদের বাঁচায়, আবার তিস্তাই মারে। গত ১০ দিন আগেও বানের পানিতে কারও বাড়িতে হাঁটু জল কোথাও কোমর পানি হয়ে ভেসেছে লালমনিরহাট তথা তিস্তা পাড়ের মানুষগুলো। ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটে হয় বন্যা। সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারীভাবে দেয়া হয় ত্রাণ সহায়তা যা কোথাও কোথাও এখনও চলমান। এই বন্যায় লালমনিরহাট জেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা হচ্ছে হাতীবান্ধা। এই লালমনিরহাট জেলা দিয়েই প্রবেশ তিস্তা নদীর। তিস্তা পাড়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভারত গজল ডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। প্রচ- গতিতে ময়লা ও ঘোলা পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসে। পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের বেশিরভাগ গেট খুলে দেয়া হয়। ফলে তিস্তার পানিতে হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, টংভাঙ্গা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাজার হাজার একর আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলি ক্ষেত তিস্তার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। দশ দিন আগের বন্যা পরিস্থিতি এখন আর নেই। সরেজমিনে লালমনিরহাটে হাতীবান্ধা উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে। যেখানে বাড়িতে কোমর পানি উঠেছিল সেখানে এখন আর কোন পানি নেই। পানির জন্য বাড়িছাড়া মানুষগুলো আবার ফিরেছে নিজ গৃহে। তবে তিস্তায় ক্ষতি হওয়া চিহ্ন স্পষ্ট এখনও। ১০-১২ দিন আগে যেখানে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পানি সেই তিস্তা এখন অনেকটাই শান্ত। উত্তর-পশ্চিম থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম হয়ে। এরপরের উপজেলা হাতীবান্ধা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিস্তা নিয়ে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার ৩৩০ মিটার উচ্চতায় হিমালয়ে তিস্তার উৎস। ভারতের সিকিমের পর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তিস্তা। তিস্তার ডান পাড়ে নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা; রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলা। আর বাঁ পাড়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলা এবং কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা। সব শেষে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। শুক্রবার দুপুরে কাঠফাটা রোদে হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নে কথা হয় ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তিস্তায় পানি কম থাকলে মাটিতে রস কম থাকে। তখন আবাদ করতি কষ্ট হয়।’ পাশে ত্রাণ নিতে দাঁড়িয়ে থাকা আক্কাস (৪০) জানান, ‘আবার কিছুদিন হামাগো সবই ভাসাই দিছে।’ আমজাদ, খোরশেদ, ইব্রাহিম কিংবা হোসনে বেগম সবাই এই তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা। কাজের সময় নারী- পুরুষ সবাই কাজ করে। যখন পানি থাকে না তখন ভুট্টা চাষ করা হয় বেশি বলেও জানালেন তারা। তবে ধানের চাষও হয়। ইরি ধান ফলন পেলেও আমন ধান চাষ করা হয় না। এবারের রোপণ করা ধানক্ষেতগুলোতে তিস্তায় আসা বানের চিহ্নও এখনও দগ দগ করছে। শুধু চাষাবাদই নয় কেউ কেউ মাছ ধরে, কেউ আবার নৌকা চালায়। এই তো তিস্তা পাড়ের নিত্য জীবন কথা। তবে তিস্তার চরগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেশ ভাল। আফসানা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। তিস্তায় ছোটবেলা থেকে কখনও বেশি আবার কখনও কম পানি দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। লেখাপড়া করে হতে চায় বড় ডাক্তারও। অন্যদের মতো সেও এসেছিল ত্রাণ নিতে। ডাউয়াবাড়ীর কয়েকটি ওয়ার্ডের লোকজন জানিয়েছে, বন্যায় তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে কোমর পানি থেকে বাঁচতে গরু-ছাগল ও নিজেদের সন্তানসহ অবস্থান করেছে জেলা শহরে কোন আত্মীয়র বাড়িতে। নয়তো যাদের আত্মীয়স্বজন নেই তারা মহাসড়কে দুই-তিন রাত কাটিয়েছে। রমজান আলী আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এই বান এখন ভাসাই দিচ্ছে আর চৈত্রী মাসে ভারত পানি আটকিয়ে রাখি। তখন পানি পেলে চাষ করতে কত দরকার।’ ইউনিয়নের একাধিক ওয়ার্ড ঘুরতে গেলে বাসিন্দারা বলেন, বন্যা শেষ হয়ে পানি নামলেও তাদের দুর্ভোগ এখনও চলছে। তবে ত্রাণের দেখা তারা পায়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কেউ কেউ দোষারোপ করেন। তবে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তাদের ত্রাণ পর্যাপ্ত আছে এবং দেয়াও হচ্ছে। ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের ওয়ার্ডগুলোতে গেলে নৌকা দেখলেই দৌড়ে আসতে থাকে বাসিন্দারা। ত্রাণ দিতে যাওয়া নেতৃত্বে থাকা তৌহিদুল ইসলাম দীপকে জড়িয়ে ধরেন এক ৬০ উর্ধ বৃদ্ধ হাজেরা বেগম। আর বলেন, ‘হামাগো একটু বেশি করে দেন আমরা খুব কষ্টে আছি, কিছু পাইনি।’ ত্রাণ নিতে আগত নারী-পুরুষ ও বাচ্চাদের আবেগে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন ত্রাণ বিতরণকারী গাজীপুর থেকে আগত মহানগর ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মী। বন্যায় বাড়িঘর ভেসে গেলেও এই কয়েকদিনে তারা ত্রাণ না পাওয়ায় এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়। জানা যায়, এখনও এই দলটির আগে কেউ কোন বরাদ্দই পায়নি। এমনকি সরকারী বরাদ্দও মেলেনি এদের ভাগ্যে। তবে উপজেলা অফিস থেকে ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ করা ত্রাণ গেল কোথায় সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ত্রাণ না পেলেও অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধেও নয়। বানবাসিরা অপেক্ষায় ছিল। মহানগরের সাধারণ সম্পাদক দীপ বলেন, আমরা শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের খোঁজ নিতে এসেছি। খাবার নিয়ে এসেছি। আপনাদের কথা প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং খোঁজখবর রাখছেন। আপনাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেব আমরা। এরপর পরিবারগুলোতে ত্রাণ দেয়া হয়। ত্রাণ পেয়ে খুশিতে গায়ে আদরের পরশ বুলিয়ে যান কেউ কেউ। অন্য ইউনিয়নে ত্রাণ দেয় স্বেচ্ছাসেবী একটি দল ‘বন্ধুমহল’। বন্ধুমহলের সদস্যরা মনে করেন, নৌকা করে এক-দুই ঘণ্টা দূরে এসে ত্রান দেয়া কষ্টকর বলেই কেউ হয়তো আসে না। সবাই স্থানীয় প্রতিনিধিকে বা শহরের কাছাকাছি কাউকে বুঝিয়ে দেয়। আর এ জন্য অনেক সময় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পায় না। আবার একজনই একাধিকবার পেয়ে যায়। একই দিনে, প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেসরকারী সংস্থার দেয়া ত্রাণ আনতে গিয়ে ফিরে এসে সন্তানের লাশ দেখেন গৃহবধূ। গড্ডিমারী ইউনিয়নের মধ্যগড্ডিমারী এলাকার ওই গৃহবধূ জাহানারা তার তিন বছরের শিশুকন্যা জান্নাতিকে রেখে ত্রাণ আনতে যান। ফিরে এসে দেখেন ঘরের পাশেই বন্যায় সৃষ্ট গর্তে জমে থাকা পানিতে ভাসছে জান্নাতির লাশ! হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন জাহানারা। তার সঙ্গে কাঁদে আশপাশের মানুষও। বাড়ির আশপাশে ত্রান দেয়ার ব্যবস্থা করলে এমন হতো না মত স্থানীয়দের। এদিকে, ত্রাণ পাওয়ার বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলার ইউএনও সৈয়দ এনামুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ত্রাণ সকল ইউনিয়নে দিয়েছি। তবুও কোন নয় ছয় করে থাকলে আমি খোঁজ নিচ্ছি, ব্যবস্থাও নেব। উপজেলার জন্য ত্রাণ প্রাপ্তি ও বিতরণ বিষয়ে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের এখনও যে ত্রাণ আছে তা ঈদ পার হয়ে যাবে। আর প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন আগামী তিন মাস এটি বহাল থাকবে। উপজেলার জন্য ২৫০ মে.টন সরকারী চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে বিশেষ বরাদ্দ আরও ৭৫ মে.টন। আর টাকা মোট ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন এবং বানভাসিদের মধ্যে ১৫৮ মে.টন চাল ও ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়াও উপজেলা পরিষদ থেকে ৭৫ হাজার টাকার শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। বিতরণ করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবারও। বানভাসিদের ত্রাণ না দিয়ে কেউ প্রতারণা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলা পরিষদ সূত্রও জানিয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণের কথা। বানভাসিদের অভিযোগও সরকারের বিপক্ষে নয়। কোন কোন ইউনিয়নে ত্রাণ পৌঁছেছে তাও জানা গেছে সরেজমিনে। তবে যারা ত্রাণ পায়নি তাদের অভিযোগ কার বিপক্ষে সেটাও স্পষ্ট করেনি। তবে দু’একজন আমতা আমতা অস্পষ্ট সুরে দোষারোপ করে আঙ্গুল তুলেছেন স্থানীয় মেম্বারদের দিকে। তিস্তা পাড়ের জীবন এমন, যখন শুষ্ক মৌসুম তখনও সারা বছরের খাবার যোগাতে যুদ্ধ করতে হয়, শ্রম দিতে হয়। তবে ভারত থেকে পানি আটকে রাখার জন্য আশানুরূপ ফলন মেলে না। আর বর্ষায় বানের পানিতেও জীবনের সঙ্গে চলে সংগ্রাম। আর খেটে-খাওয়া মানুষের এই দুঃখের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ হয়ে উঠেন আঙ্গুর ফুলে কলাগাছ। ত্রাণ দিতে আসা মানুষগুলো মনে করেন, ত্রাণ দিতে হলে দাঁড়িয়ে থেকে ত্রাণ দেওয়া উচিত যাতে করে কোন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিছু মানুষকে দিয়ে বাকিগুলো লুট করতে না পারে। তবে বানভাসিরা পাবে সরকারী বেসরকারী ত্রাণের সুফল। রাতে তিস্তা নদীতে দূর থেকে দেখা গেল তিস্তা ব্যারাজের আলো। জোৎসনার আলোয় তিস্তার পানি ও পাড়ের বালু দুইই চিকচিক করছে। শুধু পাড়ে বাস করা মানুষগুলোর জীবনই চিকচিক করে না।
×