ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কালরাতে ১৭ গুলির ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন জিল্লুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৩ আগস্ট ২০১৭

কালরাতে ১৭ গুলির ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন  জিল্লুর রহমান

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়েও বেঁচে থাকা বরিশালের ‘ক্রিডেন্স ব্যান্ড’ দলের অন্যতম সদস্য ডাঃ খ ম জিল্লুর রহমানের এখনও সেই লোমহর্ষক দিনের কথা মনে হলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। সেদিনের বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেই রাতের ভয়াল ও লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ঘাতকরা এতই পাষাণ ছিল যে, তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট শিশুসন্তান শেখ রাসেল ও আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকেও সেদিন বাঁচতে দেয়নি। নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে। ডাঃ জিল্লুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরে হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন। আরও যারা বিদেশে পালিয়ে রয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। এটা যেমন আমার কাছে ভাল লেগেছে, তারচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক হচ্ছে, যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না, আমরা বাংলাদেশ পেতাম না; সেই স্বাধীনতার স্থপতির খুনীদের বিচারে কেন এত বিলম্ব। একান্ত আলাপনে ১৫ আগস্ট ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসায় ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় সেদিনের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একজন ঘাতক সৈনিক ড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। একে একে অনেককেই লুটিয়ে পড়তে দেখে আমিও বাঁচার জন্য প্রাণপণে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকি। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার শরীরের নিচের অংশে অনেকগুলো গুলি লাগে (পরে জানতে পারি আমার শরীরে ১৩টি গুলি লেগেছিল)। এরপর আমি নিচে লুটিয়ে পড়ি। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। ওই সৈনিক একাই পরপর তিনটি অস্ত্র দিয়ে রুমের মধ্যে ব্রাশফায়ার করে। সবাই লুটিয়ে পড়ার পর অন্য একজন সৈনিক একটি রিভলবার নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অনেকের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। আমার ডান হাতে দুটি ও বাম হাতে দুটি গুলি করে। আজ আমি ১৭টি গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ঘাতক সৈনিকরা রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর কে যেন আমাকে টেনে-হিঁচড়ে ড্রয়িংরুমের সোফার নিচে লুকিয়ে রাখে। যাদের গায়ে গুলি লাগেনি, ঘাতকরা চলে যাওয়ার পর তারা পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ আমাদের রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার স্ত্রীর (শাহানারা বেগম) গায়েও গুলি লেগেছিল। ওই সময় আমি হাসনাত ভাইকে চলে যেতে অনুরোধ করি। তখন তিনি ওই বাড়ি থেকে চলে যান। পরদিন সকালে তৎকালীন রমনা থানার ওসি এসে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের বাসিন্দা ডাঃ খ ম জিল্লুর রহমান বলেন, তৎকালীন মন্ত্রী কামরুজ্জামান বরিশালে আসার পর ‘ক্রিডেন্স ব্যান্ড’ দলের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। মন্ত্রী কামরুজ্জামান আমাদের ব্যান্ডদলের গানে মুগ্ধ হয়ে পুরো দলকে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং আমাদের (শিল্পীদের) বেতারে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। মন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ডদলের ১০ সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসায় উঠেছিলাম। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন বরিশাল অপসোনিনের বর্তমান পরিচালক আব্দুর রউফ খান নান্টু। তার নেতৃত্বে আমরা ব্যান্ডদলের সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিকেলে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় একটি মিলাদেও অংশগ্রহণ করি। ওখানে আমি (ডাঃ জিল্লুর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে মিলাদের তবারক তুলে দিয়েছিলাম। জিল্লুর রহমান আরও বলেন, রাতে মন্ত্রী কামরুজ্জামানের বাসায় একটি শিশুর জন্মদিনে আমরা (ব্যান্ডদল) অংশগ্রহণ করি। ওই অনুষ্ঠানে আমাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তখন পুরস্কৃত করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ডদলের সদস্যরা সেখান থেকে চলে এসে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার নিচতলার ফ্লোরে ঘুমানোর আয়োজন করি। ১৫ আগস্ট ভোররাতে হঠাৎ গুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠপুত্র আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি সবাইকে ভেতরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ থাকতে বলে দোতলায় চলে যান। আমিসহ সকলে তখন ভয়ে কাতর হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে বিপথগামী ঘাতক সেনা সদস্যরা অস্ত্র হাতে বাড়ি ঘিরে রেখেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই নরপশু ঘাতকরা আমরা যে রুমে প্রথম ঘুমিয়েছিলাম ওই রুমের কাঁচের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। ঘাতকরা অনেকেই উর্দুতে গালিগালাজ করে আমাদের রুমের দরজা খুলতে নির্দেশ দেয়। কিছু সময় পর আমি দরজা খুলে দিলে একজন সৈনিক ভেতরে প্রবেশ করে। তখন আমাদের সঙ্গে থাকা সৈয়দ গোলাম মাহমুদ ওই সৈনিকের পা জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘স্যার আমরা এই বাসার কেউ নই, আমরা এখানে গান গাইতে এসেছি।’ তখন ওই সৈনিক আমাদের সকলকে ‘ফরোয়ার্ড’ বলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় দেখতে পাই দোতলা থেকে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ঘাতকরা নিচে নিয়ে আসছে। ওই সময় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাতকে একজন মেজরের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেছি। বেবীকে বলতে শুনেছি, আপনারা কারা? কেন আপনারা এ বাসায় এসেছেন। আপনারা জানেন, এ বাসা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতির বাসা। এরপরও সৈনিকরা সবাইকে নিচতলার ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসে। রুমে আমরা ক্রিডেন্স ব্যান্ডদলের ১০ জনসহ মোট ৩০-৩২ জন অবস্থানকালীন বাইরে প্রচ- গুলির শব্দ শুনতে পাই। জিল্লুর রহমান বলেন, সেই ভয়াল কালরাতে পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়িতে বরিশালের ছয়জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেনÑ সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত, ক্রিডেন্স শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আহত হয়েছিলাম আমিসহ নয়জন। তারা হলেনÑ বেগম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শাহানারা বেগম, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ পুত্র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, রফিকুল ইসলাম, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ। জিল্লুর রহমান বলেন, সেই ভয়াল রাতের কথা আজও মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। রাতে মাঝেমধ্যে এখনও আঁতকে উঠি। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সেই লোমহর্ষক দিনের প্রত্যক্ষদর্শী ডাঃ খ ম জিল্লুর রহমান।
×