ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন লাখ টাকায় মীমাংসা হলো গৃহকর্মী রাসেলের মৃত্যুর ঘটনা

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩১ জুলাই ২০১৭

তিন লাখ টাকায় মীমাংসা হলো গৃহকর্মী রাসেলের মৃত্যুর ঘটনা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী রাসেলের মৃত্যুর ঘটনা সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মীমাংসিত হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে টাকার বিনিময়ে গৃহকর্মী নির্যাতন মামলা মীমাংসার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। মূলত, গৃহকর্মী নির্যাতনের বিচার শেষ হওয়ার আগেই ৭০ ভাগ মামলা আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়ে যায়। সাধারণত গৃহকর্মীরা অত্যন্ত গরিব হওয়ায় প্রভাবশালী নির্যাতনকারী গৃহকর্তা কর্তৃক ভয়-ভীতির কারণে অনেক সময় নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে এসব মামলা আপস-মীমাংসা করে ফেলে। যা গৃহকর্মী রাসেল মৃত্যুর ঘটনাতেও স্পষ্ট। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতের চাচা জানিয়েছেন, ‘সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছে আমাদের। এর মধ্যে দুই লাখ টাকা নগদ দিয়েছে, বাকি দেড় লাখ টাকা চেকে দিয়েছে।’ মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীদের মতে, গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় আসামিদের সাজার হার নগণ্য এবং এসব মামলায় দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলেই নির্যাতনের ঘটনা কমছে না। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়কারী ও নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ গৃহকর্মী রাসেলের মৃত্যুর ঘটনায় টাকার মাধ্যমে আপস করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, গৃহশ্রমিক নির্যাতন ও হত্যার আরও বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব ক্ষেত্রেও সমঝোতায় মাধ্যমে মীমাংসা করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। মূলত গৃহশ্রমিকের পরিবারের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে, টাকার বিনিময়ে সন্তানের মৃত্যুর সমঝোতার ঘটনা দেশকে জাহেলিয়াতের যুগে নিয়ে যাবে। সম্প্রতি সরকার ঘোষিত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশে একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত কারণে গৃহশ্রমিকের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যানুযায়ী, গৃহকর্মী নির্যাতন মামলার ৩০ শতাংশ মূলত সাক্ষী না আসায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে। আর দীর্ঘদিন পর বিচার শেষে এসব মামলায়ও শাস্তির নজির তেমন নেই। সব মিলিয়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের ৯৯ ভাগ মামলায় আসামিদের শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, কিশোর গৃহকর্মী রাসেল মৃত্যুর মামলার মতো টাকার বিনিময়ে অপরাধীরা মীমাংসা করে নেন ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে। কারণ ভিকটিমের পরিবার গরিব। প্রায় ৭০ ভাগ গৃহকর্মী নির্যাতন মামলা এভাবেই আপস হয়। গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতনের মামলার রায়ে গৃহকর্ত্রী নদী যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হয়েছে। কারণ আদুরীর পরিবার শেষ পর্যন্ত ‘বিক্রি হয়নি’ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলাই হয় না। ঘটনার শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। শুধু গুরুতর অপরাধের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা হয়। আর অধিকাংশ মামলায় আদালতের বাইরে বাদী ও বিবাদীর মধ্যে ‘আপোস’ হয়ে যায়। বাকি স্বল্পসংখ্যক মামলা দীর্ঘদিন বিচারাধীন থেকে পরিশেষে সেগুলোও মীমাংসা হয়ে যায়। শিশু সোহাগী (১০)। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের বিয়ে হয় অন্যত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে গৃহকর্মী হিসেবে রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের একটি বাসায় ঠাঁই হয়। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় তার ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। সোহাগীর শরীরে গরম পানি, ভাতের গরম মাড় ঢেলে নির্যাতন করা হতো। এমনকি বিষাক্ত হারপিক ঢেলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঝালসে দেয়া হতো। ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর দিলু রোডের ২৭/এ নম্বর বাসা থেকে গুরুতর অবস্থায় সোহাগীকে উদ্ধার করে র‌্যাব-৩ এর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার সোলায়মান। এ সময় বাসার মালিক মশিউর রহমান ও তার স্ত্রী কাজী মাহরুনা রহমান লিমাকে আটক করে রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩ এর ৪ (৩) ধারায় একটি মামলা করেন র‌্যাবের ওই ওয়ারেন্ট অফিসার। ২০১০ সালের ২২ নবেম্বর দুজনের নামে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মামলার বাদীসহ পাঁচজন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে সাক্ষীরা নিয়মিত আদালতে সাক্ষ্যপ্রদান করতে না আসায় সাত বছর ধরে মামলাটি ঝুলে আছে। ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান ওরফে নিত্য শাহাদাতের বিরুদ্ধে সাংবাদিক খন্দকার মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রীকে বেকসুর খালাস দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর বিচারক তানজিলা ইসমাইল। নিজেদের মধ্যে আপস-মীমাংসা হওয়ায় এবং ভিকটিম নির্যাতনের বিষয়টি আদালতে অস্বীকার করায় আসামিরা বেকসুর খালাস পান। যদিও এর আগে শিশু গৃহকর্মী হ্যাপি আদালতে ২২ ধারায় তার ওপর নির্মম নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যানুসারে, ২০১৬ সালে মোট ৯০ জন গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর কর্মস্থলে খুন হয়েছেন ১৪ জন গৃহকর্মী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সংস্থার সদস্য এ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, গত তিন বছরে রাজধানীতে গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রায় ২৫টি মামলায় ভিকটিমকে আইনী সহায়তা প্রদান করেছে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। এর মধ্যে ৭০ ভাগ মামলার ক্ষেত্রে বাদী ও বিবাদী আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসা করেছেন। বাকি ৩০ ভাগ মামলা দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে ঝুলে আছে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি গৃহকর্মী আদুরী নির্যাতন মামলার রায় এ যাবৎকালের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রায়ে আসামি গৃহকর্ত্রী নদীর যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে, যা গৃহকর্মী আদুরী পাবে। এ মামলাটি ছাড়া বিগত আট-দশ বছরের মধ্যে এ প্রকৃতির মামলায় এমন দৃষ্টান্তমূলক সাজার নজির আমার জানা নেই।
×