ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিনজন রিমান্ডে, একজনের আদালতে স্বীকারোক্তি

বগুড়ায় তরুণী ধর্ষণ ও মাকে নির্যাতন ॥ ধর্ষককে শ্রমিক লীগ থেকে বহিষ্কার

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩১ জুলাই ২০১৭

বগুড়ায় তরুণী ধর্ষণ ও মাকে নির্যাতন ॥ ধর্ষককে শ্রমিক লীগ থেকে বহিষ্কার

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ তরুণীকে ধর্ষণ ও ধর্ষিতাসহ তার মাকে নির্যাতন চালিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনায় বগুড়ার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সচেতন মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে। রবিবার বিকেলে ধর্ষক তুফান সরকার ও তার সহযোগী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। একই সঙ্গে একজন বখাটে সন্ত্রাসী থেকে কিভাবে তুফান সরকার কোটি টাকার মালিক ও প্রভাবশালী হয়ে উঠল তা নিয়েও শহরের সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা। অপর দিকে এই মামলায় ধর্ষকের সহযোগী আতিক আদালতে স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া ধর্ষক ও তার অপর দুই সহযোগী-আলী আজম দিপু ও রুপমকে জিজ্ঞাসবাদের জন্য পুলিশের আবেদনে আদালত রবিবার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। বিকেলে তাদের বগুড়া অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ধর্ষণের শিকার তরুণী ও তার নির্যাতিত মা বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য সেখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এদিকে ধর্ষক তুফান সরকারকে জাতীয় শ্রমিকলীগ বগুড়া শহর শাখা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্যাতনের ঘটনায় পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি জড়িত অভিযুক্ত থাকায় সহ প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সামাদকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক সহিদুল ইসলাম খান ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। জেলা প্রশাসক নুরে আলম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, নির্যাতিত তরুণীর লেখাপড়া ও আইনগত সহযোগিতাসহ সবধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্ত মহিলা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে রবিবার বিকেলে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মানববন্ধন থেকে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিসহ এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তুফান সরকারের দেহরক্ষীদের একজন গ্রেফতারকৃত আতিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিতে জানায়, তুফান সরকারের কসাইপাড়ার বাড়িতে ওই তরুণীকে ডেকে নেয়ার পর ধর্ষণ করা হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এ সময় সে ওষুধ এনে দেয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ধর্ষিতা তরুণীকে শুক্রবার নির্যাতন করার অন্যতম অভিযুক্ত মহিলা কাউন্সিলরসহ অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তরুণীটি মানসিক বিপর্যস্ততা কাটালে তার মেডিক্যাল রিপোর্টসহ মামলার প্রয়োজনী অন্য পদক্ষেপ নেয়া হবে। রবিবার তুফান সরকার ও তার দুই সহযোগী দিপু ও রুপমকে বগুড়া অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। আদালত শুনানি শেষে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সকালে জেলা প্রশাসক নুরে আলম সিদ্দিকী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত তরুণী ও মা’র খোঁজখবর নেন। চিকিৎসাসহ কলেজে পড়ার সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এদিকে ধর্ষণে প্রধান অভিযুক্ত তুফান সরকার গ্রেফতার হওয়ার পর এ নিয়ে শহর জুড়ে চলছে নানা আলোচনা। তুফান সরকারের বিরুদ্ধে বগুড়ায় দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, দখল ও মাদক ব্যবসা চালনোর অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ তার পরিবারের অরও কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে। ইতিপূর্বে সে ফেন্সিডিল ও ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে তার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যা চেষ্টা মাদক ব্যবসাসহ নানা অভিযোগে ৪টি মামলা রয়েছে। তাকে চাঁদা না দিয়ে শহরে ব্যাটারিচালিত কোন অটোরিক্সা কেউ চালাতে পারত না। চাঁদা না দিলেই দরিদ্র চালকদের বিরুদ্ধে চলতো নির্যাতন। ইতিপূর্বে জনকণ্ঠে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুলিশ চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়। তবে শহর জুড়ে তুফানবাহিনী এক ত্রাস। সম্পত্তি দখল থেকে সবধরনের দখলে তার বাহিনী সিদ্ধহস্ত। মাদক ছাড়াও জুয়ার আসর তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম উৎস। শহরের তালুকদার মার্কেটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, ৩ মাস আগে রাজা মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীকে ওই মার্কেট থেকে উচ্ছেদ করে তার দোকান দেখলে নেয় তুফানবাহিনী। দোকান দখল করে সে সময় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লেখা হয়, ‘সব সমস্যার সমাধান তুফান সরকার” তার ভয়ে ওই দোকানি নামমাত্র মূল্যে দোকান বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে ব্যবসা ছাড়েন। তুফান ছাড়াও তার অরও কয়েক ভাই কয়েকটি হত্যাকা-ের মাধ্যমে অপরাধ সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। মেলার নামে মাসের পর মাস জুয়ার আসর ও মাদক ব্যবসা তাদের করে তোলে ধনাঢ্য। শ্রমিক লীগের আশ্রয়ে সে ও তার বাহিনী হয়ে ওঠে ক্ষমতাধর। উল্লেখ্য, এ বছর এসএসসি পাস নির্যাতিত তরুণীকে ভাল কলেজে ভর্তি করে দেয়ার নাম করে শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার ১৭ জুলাই শহরের চকসূত্রাপুর কসাইপাড়া এলাকায় তার বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনার পর ধর্ষকের স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন অপবাদ দিয়ে শুক্রবার দুপুরে ধর্ষিতা তরুণী ও তার মাকে বাদুড়তলা এলাকায় মহিলা কাউন্সিল মার্জিয়া হাসান রুমকির বাড়িতে নিয়ে যায়। রুমকি তুফানের স্ত্রী আশার বড় বোন। সেখানে নির্যাতন করে ওই তরুণী ও তার মার মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। পরে ধর্ষিতা তরুণী ও তার মাকে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে রবিবার বিকেলে শহরের সাতমাথায় সুশাসনের বগুড়া সচেতন নাগরিক সমাজ, সুজন, সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটি বগুড়া জেলা শাখা, উদীচী বগুড়া জেলা শাখা ও প্রথম আলো বন্ধু সভা মানববন্ধন করে। এতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সহ রাজনীতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে এসব ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। মানববন্ধনে অংশ নেয়া স্কুল ছাত্রীরা ধর্ষণের বিচার ও প্রতিবাদ জানাতে চোখে কালোকাপড় বাঁধে। সমাবেশ থেকে বক্তারা বলেন, তুফান সরকার ও তার লোকজন দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছে। এরা একদিনই শক্তিশালী হয়নি। এ ধরনের সন্ত্রাসী অপশক্তি কোন দলের জন্যই ভাল হতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক সমাজ রুখে দাঁড়াবে।
×