ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চারজনের সাফল্যের নেপথ্য কাহিনী;###;নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন;###;রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ

পাবদা চাষে বছরে মুনাফা ১২ লাখ, রুইয়ে ১০ লাখ টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৮ জুলাই ২০১৭

পাবদা চাষে বছরে মুনাফা ১২ লাখ, রুইয়ে ১০ লাখ টাকা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ওরা চারজন। প্রত্যেকেই সফল উদ্যোক্তা। তাদের উদ্যোগের কেন্দ্রে রয়েছে মাছ। কেবল পাবদা মাছ চাষ করে এক বছরেই একজনের মুনাফা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। অন্য একজন পাহাড়ী জলাশয়ে রুই মাছ চাষ করে মুনাফা করেছেন ১০ লাখ টাকা। আরেকজন হ্যাচারিতে রেণু উৎপাদনে ব্যবহার করেছেন নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি, যা পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। অন্যজন মাছ রফতানি করেই হয়েছেন কোটিপতি। এসব অনুসরণীয় কর্মকা- তাদের এনে দিয়েছে স্বীকৃতি। পেয়েছেন ২০১৬ সালের জাতীয় মৎস্য পুরস্কার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। জনকণ্ঠকে নিজেদের সাফল্যের পেছনের গল্প বলেছেন তারা। রেণু উৎপাদনে রিসাইক্লিং পদ্ধতি যশোরের একরামুল কবির। তিনি মধুমতি মৎস্য হ্যাচারির মালিক। মৎস্য খাতে বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছর তিনি পেয়েছেন ‘জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৬’। রেণু উৎপাদনে মাটির উপরিভাগের পানি পরিশোধন করে পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে বিশেষ চমক সৃষ্টি করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করেছেন স্বর্ণপদক। তার সাফল্যে যশোর সদরের অন্য হ্যাচারি মালিকরা কিভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তা জানতে দীর্ঘ কথা হয় গুণী এই হ্যাচারি মালিকের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বর্তমানে মধুমতি হ্যাচারি ছাড়াও কয়েকটি হ্যাচারিতে পানি পরিশোধন করে পুনঃব্যবহারের কাজ চলছে। তবে ওইসব হ্যাচারিতে রিসাইক্লিংয়ের কাজ এখনও পুরো শুরু হয়নি। আর আমার এই সাফল্য অন্য হ্যাচারি মালিকদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। হ্যাচারি শুরুর গল্প বলতে গিয়ে একরামুল কবির বলেন, বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। সম্পৃক্ত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গেও। একটা দুর্ঘটনায় ১৯৭৩ সালে তিনি মারা গেলেন। তখন চাচা আবুল বাশার ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নেই। চাচার কাছেই আমাকে বড় হতে হয়েছে। চাচার ছিল ৫ ছেলে। তখন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন তিনি। তার আয়ে পরিবার চলছিল। পরিবার চালাতে চাচার খুব কষ্ট হচ্ছিল। পরিবারে আমিই সবার বড়। ইন্টারে পড়ছি। তখন ভাবলাম লেখাপড়া ছেড়ে যদি পরিবারের হাল ধরতে পারি তাহলে পরিবারটা স্বাচ্ছন্দ্যে চলবে। সে ভাবনা থেকেই মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। ছোট্ট একটা হ্যাচারি দিয়ে শুরু করি। বর্তমানে আমার হ্যাচারি থেকে বছরে ৫ হাজার কেজি রেণু উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, রেণু উৎপাদন করতে গিয়ে একদিকে পুষ্টি অন্যদিকে পরিবেশের কথা চিন্তা করতে হয়। মাছ চাষ করা হবে ঠিকই তবে তা মানুষকে সহজে কেনার মতো পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। কোনক্রমেই মাছের দাম বাড়ানো যাবে না। সে ভাবনা থেকেই রেণু উৎপাদনে খরচ কমানোর চেষ্টা করি। চিন্তা করতে থাকি কিভাবে বিদ্যুত ব্যয় হ্রাস করা যায়। রেণু উৎপাদনে নদীর পানির মতো প্রবাহ তৈরি করতে হয়। সে ভাবনা থেকে গ্রিন এনার্জি ও পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করি। ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে মাটির উপরিভাগের পানি অর্থাৎ নদী-খাল-বিলের পানি ব্যবহার শুরু করি। আবার রেণু উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে উপরিভাগের পানি বেশি উপযুক্ত। তাই এই পানিই এখন রিসাইক্লিং করে ব্যবহার করছি। জনকণ্ঠকে একরামুল বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও ৯৭ সালে হ্যাচারি শুরু করেন তিনি। কমবেশি সব হ্যাচারি রেণু উৎপাদন করলেও যশোরই সেরা। তার ভাষায়, রেণু উৎপাদন করতে গিয়ে পানির অপচয় হয়, প্রয়োজন পড়ে ভূগর্ভস্থ পানি। তবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বিপর্যয়ে পড়বে হ্যাচারি খাত। তিনি বলেন, ১ কেজি রেণু উৎপাদন করতে ৪০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। একবার ব্যবহার করেই ওই পানি ফেলে দিতে হয়। তবে আমার হ্যাচারিতে পানি পরিশোধন করে ওই পানি আবার ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় একই পানি বারবার ব্যবহার হচ্ছে। আমার হ্যাচারিতে বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার কেজি রেণু উৎপাদন করি। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক অপচয় হতো। তবে পানি পরিশোধ করে রেণু উৎপাদন কাজে ওই পানি ব্যবহার করায় পানির অপচয় রোধ হচ্ছে। বর্তমানে আমরা মাটির উপরিভাগের পানি ব্যবহার করছি। ২০১৪ সাল থেকে রিসাইক্লিং করে আসছি। এতে বিদ্যুত বিল ও নলকূপ স্থাপনের বাড়তি খরচও কমছে। তিনি আরও বলেন, পানি পরিশোধনের এ পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ। প্রথমে একটি প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। এই প্ল্যন্ট তৈরির সব যন্ত্রপাতি দেশেই পাওয়া যায়। প্ল্যান্ট তৈরিতে সাড়ে ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। গুণী এই হ্যাচারি মালিকের তথ্যমতে, ওই এলাকায় আরও কয়েকটি হ্যাচারিতে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি মাছ চাষ রেজাউল কবির একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি যুক্ত আছেন মৎস্য খাতে। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাকনি গ্রামের এই বাসিন্দা পাবদা মাছ চাষ করে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়ে চলতি বছর অর্জন করে নিয়েছেন ‘জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৬’। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করেছেন রৌপ্যপদক। ২০১৬ সালে পাবদা মাছ চাষে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তার লাভ হয়েছে ১২ লাখ টাকা। শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে শাকিব ফিশারিজের মালিক রেজাউল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, বন্ধুদের অনেকেই মাছ চাষ করত। বিশেষত কুমার প-িত ও নুরুল আমিনের ফিশারি দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। বাড়তি আয়ের ইচ্ছা ও তাদের অনুপ্রেরণাতে ২০০০ সালে মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ৫ কাটা জমিতে ফিশারির কার্যক্রম শুরু করি। চাষ করি কৈ মাছ। টানা কয়েক বছর খুব লাভ হয়। পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরে আসে। তবে ২০১৪-১৫ সালে কৈ মাছে মড়ক দেখা দেয়। তখন লোকসান গুনতে হয়। এলাকার অনেকেই তখন পাবদা ও গুলশা মাছ চাষ শুরু করে। তাদের দেখাদেখি ২০১৬ সালে পাবদা মাছ চাষ শুরু করি। বছরটিতে ফিশারিতে খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা। আর আমার লাভ হয় ১২ লাখ টাকা। বর্তমানে ৫ একর জমিতে আমার ফিশারিতে ৮টি পুকুর রয়েছে। তিনি জানান, তার মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখে ওই এলাকার অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। পাহাড়ী জলাশয়ে রুই মাছ চাষ রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার মোহাম্মদী পাড়ার বাসিন্দ রশিদ আহমেদ। অনগ্রসর এলাকায় মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় চলতি বছর তিনিও পেয়েছেন ‘জাতীয় মৎস্য পুরস্কার-২০১৬’। রুই জাতীয় মাছ চাষ করে বিশেষ সাফল্য অর্জন করায় পুরস্কার গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে। শুরুর গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০৬ সালে অন্যের পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করি। বর্তমানে প্রায় ৪ একর আয়তনের ৩টি পুকুরে রুই জাতীয় মাছ চাষ করছি। ২০১৬ সালে ওই তিন পুকুর থেকে ১৭ লাখ ১৮ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করি। তবে বছরটিতে আমার খরচ হয়েছিল ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর আমার লাভ হয় ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অনগ্রসর এলাকায় রুই জাতীয় মাছ চাষে বিশেষ সাফল্যের কারণে আমি এই পুরস্কার পেয়েছি। কথা বলে জানা গেছে, মাছ চাষে রশিদের এই সাফল্যে লংগদু উপজেলার মানুষ উল্লাসিত। তার ভাষায়, প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমার এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে মোহাম্মদী পাড়ার বাজার ব্যবসায়ীরা সবাই খুব আনন্দিত। সবাই আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। এত বড় পুরস্কার পাব তা কোনদিন আমি কল্পনাও করিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি অবসরে যান। মাছ রফতানি করে কোটিপতি খুলনার রেজাউল হক। মাছ রফতানিতে তার প্রতিষ্ঠান শীর্ষে অবস্থান করায় চলতি বছর তিনিও পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার। সর্বোচ্চ মাছ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্রাইট সি ফুড লিমিটেডের কর্ণধার রেজাউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে আমি মৎস্য ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ৯০ সালে মাছ রফতানি শুরু করি। প্রথমে বিভিন্ন কোম্পানিতে মাছ সরবরাহ করলেও পরে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা শুরু করি। তবে পার্টনারদের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় যৌথ ব্যবসা থেকে সরে আসি। পরে আবার ব্যবসা শুরু করি। তিনি বলেন, মূলত কলেজ জীবন থেকেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। এক সময় চিংড়ি মাছের ফার্মে কাজ করেছি। সেখানে ১ বছর কাজ করার পর নিজের ফার্ম শুরু করি। বর্তমানে ২টি চিংড়ির ফার্ম ও মাছ রফতানির প্যাকেজিং সামগ্রী তৈরির প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লোকে আমাকে কোটিপতিই বলে। মাছের রফতানির মাধ্যমেই আজ আমি সুপ্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী। পূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাছ সাপ্লাইয়ের যে ব্যবসা ছিলো অর্থাৎ ট্রেডিংয়ের ব্যবসাটি এখনও আমার আছে। মাছ রফতানির মাধ্যমেই আমার আজকের এই অবস্থান। তিনি বলেন, সতত ও নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করলে সব ব্যবসাতেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তার জন্যে প্রয়োজন অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম।
×