ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামের সিএসডি থেকে অর্ধ কোটি টাকার চাল লোপাট

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৯ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রামের সিএসডি থেকে অর্ধ কোটি টাকার চাল লোপাট

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশে খাদ্য সঙ্কট নিরসনে যেখানে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাল আমদানি শুরু হয়েছে এবং বেসরকারী পর্যায়কেও উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে সরকারী গুদাম থেকে কোটি কোটি টাকার চাল লোপাট হয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার দেশের বৃহত্তম সিএসডি (সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো) থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার পর সাগরিকা এলাকা থেকে র‌্যাব সদস্যরা আটক করেছে সাতটি ট্রাকবোঝাই ১৫৫ টন চাল, যার আনুমানিক মূল্য অর্ধকোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে চালের পরিমাণ বলা হয়েছে ৩৫৫ মেট্রিক টন! যেসব স্পট থেকে চালবোঝাই এসব ট্রাক আটক করা হয়েছে সেসব এলাকার সূত্রে বলা হয়েছে, আটক ট্রাকের সংখ্যা ১০। কিন্তু র‌্যাবের পক্ষ থেকে তা কেন সাত ট্রাক বলা হলো এর কোন ব্যাখ্যা মেলেনি। এ ঘটনায় সিএসডির ম্যানেজার প্রণয় চাকমাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচজনকে। গ্রেফতারকৃত অপর চারজন ট্রাকচালক ও হেলপার। এ ঘটনার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ১৩টি সিএসডি রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম বৃহৎ দুটি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত। একটি হালিশহরে ও অপরটি দেওয়ানহাটে। হালিশহর সিএসডির ধারণক্ষমতা এক লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। পক্ষান্তরে দেওয়ানহাট সিএসডির ধারণক্ষমতা প্রায় ৭০ হাজার টন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে এ দুটি সিএসডি থেকে কমপক্ষে সাত হাজার টন চাল লোপাট হয়েছে। এ লোপাট প্রক্রিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য অধিদফতর থেকে জেলা অধিদফতর হয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা গুদাম কর্মকর্তার কারসাজি জড়িত। দেশে সম্প্রতি দুর্যোগের কারণে সরকার যেখানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠিত হয়ে খাদ্যের বাফার স্টক গড়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের অবৈধ পথে কালোবাজারে চাল বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার এ প্রক্রিয়াটি নতুন করে উদ্ঘাটিত হলো। র‌্যাব সূত্রে জানানো হয়েছে, তারা গোপন সূত্রের খবরের ভিত্তিতে হালিশহর এলাকা থেকে চার ট্রাক ও সিটিগেট এলাকা থেকে তিন ট্রাকবোঝাই চাল আটক করেছে। প্রাথমিকভাবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে এ চালের পরিমাণ ১৫৫ মেট্রিক টন বলা হলেও পরবর্তীতে তা ৩৫৫ মেট্রিক টন বলে গণমাধ্যমকর্মীদের জানানো হয়েছে। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, মূলত চালবোঝাই ট্রাক আটক করা হয়েছে ১০টি। কিন্তু প্রকাশ করা হয়েছে সাতটির কথা। খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে স্বীকার করা হয়েছে, তাদের জানামতে হালিশহর সিএসডি গোডাউন থেকে মঙ্গলবার ১০ ট্রাক চাল অবৈধভাবে ডেলিভারি দেয়া হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। এ ১০ ট্রাক চালই ধরা পড়েছে। কিন্তু র‌্যাবের পক্ষ থেকে তা সাত ট্রাক কেন বলা হয়েছে তার কোন উত্তর মেলেনি। বাকি তিন ট্রাক চাল কারা গায়েব করল তার উত্তরও মেলেনি। চট্টগ্রামের এ দুটি সিএসডির অধীনে ছোট বহু গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে হালিশহর সিএসডির অধীনে রয়েছে ১২৬টি গোডাউন। এব গোডাউনে সব সরকারী খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে চাল এবং গমই মজুদ রয়েছে। হালিশহরের সিএসডি দেশের বৃহত্তম হওয়ায় এ ডিপো থেকে সারাদেশে চাল-গম সরবরাহ হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে দেওয়ানহাট সিএসডি থেকেও অনুরূপভাবে খাদ্য বিভাগের কর্মসূচী অনুযায়ী সরবরাহ দেয়া হয়। শুধু চট্টগ্রাম বিভাগ নয়, এর বাইরেও চাল-গম সরবরাহ হয়ে থাকে বিভিন্ন উপজেলাকেন্দ্রিক গোডাউনগুলোতে। খাদ্য বিভাগের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মাধ্যমে এ সরবরাহ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। মঙ্গলবার যে চালের চালান অবৈধভাবে সিএসডি থেকে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। খাদ্য বিভাগের কর্মসূচী অনুযায়ী গত ১০ জুলাইয়ের মধ্যে এ চাল ডেলিভারি হয়েছে বলে রেকর্ড করা হয়েছে। অনুরূপভাবে বিভাগের বিভিন্ন খাদ্য বিভাগের গুদাম কর্মকর্তাদেরও অনুরূপ পরিমাণ চাল গ্রহণ করার কাগজপত্র তৈরি করা আছে। পরবর্তীতে এলাকাভিত্তিক ইউপি চেয়ারম্যানরা এসব চাল ভিজিএফ কর্মসূচীর মাধ্যমে বিতরণ করেছে বলে রেকর্ড রয়েছে। মূলত চাল হালিশহর সিএসডিতেই ছিল। সুযোগ বুঝে মঙ্গলবার তা পাচারকালে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে। প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী সরকারী চাল লোপাট প্রক্রিয়ায় উঁচু মহল থেকে শুরু করে উপজেলাসমূহের ওসি এলএসডি (অফিসার ইনচার্জ লোকাল স্টোরেজ ডিপো) পর্যন্ত জড়িত। শুধু তাই নয়, এ প্রক্রিয়াটি এমন জালিয়াতির অতল গহ্বরে নিপতিত যে, সরকারী চাল লোপাটের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার এটি একটি শক্ত চেন। এতে প্রতিটি পয়েন্টে অর্থ পৌঁছে যায়। ফলে গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে যত সোচ্চার ভূমিকায় থাকুক না কেন, বিষয়টি একপর্যায়ে ঢাকা পড়ে যায়। সূত্র জানায, গত দুই মাসে এ দুটি সিএসডি থেকে সাত হাজার টনের বেশি চাল অনুরূপ প্রক্রিয়ায় লোপাট হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি সরকারের জন্য দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি গোডাউন কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পোস্টিং নিতে হয়। সিএসডিগুলোতে ম্যানেজারের পোস্টিংয়ের বিপরীতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা প্রদান করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এলএসডিগুলোতে তা প্রায় ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত দর ওঠে। এত মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে পোস্টিং নেয়ার পর এরা গোডাউনের সরকারী চাল চোরাই পথে বিক্রি করে তার দ্বিগুণ-তিনগুণ অর্থ হাতিয়ে নিতে তৎপর থাকে। এটাই খাদ্য বিভাগের গুদাম কর্মকর্তাদের নিয়মিত কর্মকা- হিসেবে আলোচিত। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে বিষদ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে নানান ঘটনা, যা কিনা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো। কাগজে-কলমে সবই থাকে ঠিকঠাক, অথচ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর চাল-গম যেভাবে লোপাট হয়ে যায় তা বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। শুধু তাই নয়, সরকারী গুদামগুলোতে নিম্নমানের চাল গ্রহণ করে ভালমানের চাল বদলানোর ঘটনাও ঘটে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকার যেখানে নিজ উদ্যোগে প্রায় ১২ লাখ টন এবং বেসরকারী পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং তা টাকার অঙ্কে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকাÑ এ অবস্থায় সরকারী গুদামের চাল-গম লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণ করার দাবি উঠেছে তাৎক্ষণিকভাবে। চাল-গম লোপাটের এ প্রক্রিয়ায় উচ্চপর্যায় থেকে গুদাম কর্মকর্তা পর্যন্ত মুখোশ উন্মোচন করা সময়ের দাবি। কেননা, এ প্রক্রিয়াটি চলে আসছে বহুদিন ধরে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চালের আড়তদারদের গুদামগুলোতে সরকারী আমদানির চাল বিক্রি হয়ে থাকে অবাধে। পাহাড়তলীতে অসংখ্য ওয়্যারহাউস গড়ে উঠেছে চাল মজুদ করার জন্য, যেখানে বেসরকারী পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারী পর্যায়ের লোপাটকৃত চালও থাকে। এসব ওয়্যারহাউসগুলোতে অভিযান চালিয়ে এর পরিসংখ্যান নির্ণয় করে তা কারা রেখেছে এবং কোন পথে এসেছে, তা তদন্তের দাবি রাখে বলেও সূত্রে জানানো হয়েছে।
×