ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আপনি নাকি অপহরণ হয়েছেন?’-অর্চনা ॥ ‘না, আমার কিছু হয়নি। ভাল আছি’- ফরহাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ জুলাই ২০১৭

‘আপনি নাকি অপহরণ হয়েছেন?’-অর্চনা ॥ ‘না, আমার কিছু হয়নি। ভাল আছি’- ফরহাদ

শংকর কুমার দে ॥ ‘আপনার সম্পর্ক আমার পেটে’Ñ অপহরণের নাটক সাজানোর আগের দিন ফরহাদ মজহারকে মোবাইল ফোনে বলেছিলেন তার ভক্ত অর্চনা রানী। তার এই কথা বলার পর খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। এখান থেকেই মূলত, ফরহাদ মজহারের সাজানো অপহরণের নাটকের উৎপত্তি। যেদিন ফরহাদ মজহার অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন সেদিনই অর্চনা রানী ফোনে বলেন, ‘আপনি (ফরহাদ মজহার) নাকি অপহরণ হয়েছেন?’ উত্তরে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘না, আমার কিছু হয়নি, ভাল আছি।’ ফরহাদ মজহার ও অর্চনার ফোনের এই কথার ভয়েস রেকর্ড সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ফরহাদ মজহার যে অপহরণ হননি, তার ভয়েস রেকর্ড তিনি অস্বীকার করবেন কিভাবে? শুধু তাই নয়, অপহরণের ঘটনার দিন বিকেলে পরিবারের লোকজন যখন গণমাধ্যমে কথা বলছিলেন তখন তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে তার স্ত্রীকে ফোনে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কথা বলা বন্ধ করো। অপহরণের কথা বলার দরকার নেই। ওরা বলেছে ছেড়ে দেবে। এটা নিয়ে আর কথা বোলো না।’ ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীকে আরও বলেন, ‘তোমার কাছে যে টাকা আছে তা রেখে দাও। পরে কাজে লাগবে।’ খুব শীঘ্রই ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ফরহাদ মজহারকে ‘গুরু বাবা’ বলে ডাকতেন অর্চনা। গুরু বাবার ‘সেবাদাসী’ হন তিনি। অর্চনার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে গর্ভবতী হয়ে উঠার কারণে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অপহরণের নাটক সাজানো হয়েছে। ফরহাদ মজহার তার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ব্ল্যাকমেল করে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে গিয়েই অপহরণের নাটক সাজিয়ে ১৮ ঘণ্টা অন্তর্ধান ছিলেন তিনি। ফরহাদ মজহারের সাজানো অপহরণের নাটকের সেই শ্বাসরুদ্ধকর ১৮ ঘণ্টায় যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার মধ্যে ফরহাদ মজহার, তার স্ত্রী ফরিদা আখতার, তার ভক্ত অর্চনা রানীর ভয়েস রেকর্ড, কললিস্ট, ভিডিও ফুটেজ, সিটি টিভির ফুটেজসহ প্রযুক্তিগত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জুলাই ভোর ৫টায় শ্যামলীর নিজ বাসা থেকে বের হয়ে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার ১৮ ঘণ্টা চেষ্টার পর উদ্ধার করার সময় পর্যন্ত মোবাইল ফোনে নিজের স্ত্রী ফরিদা আখতারের সঙ্গে কথা বলেছেন ১০ বার। আর তার ভক্ত অর্চনা রানীর সঙ্গে কথা বলেছেন ৬ বার। এদিন সন্ধ্যা ৭টার কিছু সময় আগে ফরহাদ মজহার খুলনার একটি মার্কেটের দোকান থেকে অর্চনা রানীকে দুই দফায় ১৩ হাজার ও ২ হাজার করে মোট ১৫ হাজার টাকা রকেটের মাধ্যমে পাঠান। ফরহাদ মজহার যে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার, তার ভক্ত অর্চনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যেসব কথোপকথন হয়েছে তার কললিস্ট ও ভয়েস রেকর্ড সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঘটনার দিন শ্যামলীর বাসা থেকে বের হয়ে খুলনার নিউমার্কেটের দোকানে থেকে টাকা পাঠানো, যশোরের বাসের টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কাটার ভিডিও ফুটেজ ও সিসি টিভির ফুটেজ এখন তদন্তকারী কর্মকর্তাদের হস্তগত। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)-তে সংগ্রহ করার সিসি টিভিতে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গত ৩ জুলাই, সন্ধ্যার দিকে ফরহাদ মজহার খুলনা নিউমার্কেটে ঢোকেন। তিনি আবার বের হতে চান। কিন্তু লোকজন দেখে কেমন যেন থমকে যান। এক পা এগিয়ে যান, আবার পিছু হটেন। দেখে মনে হয়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন তিনি। এরপর নিউমার্কেটের দোতলায় ওঠেন। কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে আসেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিকাশের একটি দোকানে ফরহাদ মজহার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে থাকা একটি কালো রঙের মোবাইল ফোন টিপছেন। পরে ফোনে কথা বলতেও দেখা যায়। পুরো সময় তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি এবং মাথায় সাদা পাগড়ি ছিল। বাঁ কাঁধে তার ব্যাগটিও দেখা যায়। এ সময় ফরহাদ মজহার মোবাইল রকেটের মাধ্যমে অর্চনাকে একবার ১৩ হাজার, আরেকবার দুই হাজার মোট ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। ওই দোকানেই দাঁড়িয়ে আবার অর্চনাকে ফোন করে জানতে চান, তিনি টাকা পেয়েছেন কিনা। অপহরণের সাজানো নাটকের ঘটনার আগে-পরে যেহেতু অর্চনা নামের নারীর প্রসঙ্গ সামনে এসেছে সেই কারণে তার বক্তব্য নেয়াও পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অর্চনা রানী আদালতে ও পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর তিনি নিজেও আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি উদ্ধারের পর যে বক্তব্য দিয়েছেন, অর্চনা যে জবানবন্দী দিয়েছেন তার সঙ্গে অপহরণের ঘটনার মামলার তদন্তে পাওয়া তথ্যর কোন মিল নেই। এ কারণে ফরহাদ মজহারকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অর্চনা রানীর গর্ভে ফরহাদ মজহারের সন্তান আসার পর প্রথম যখন গর্ভপাত ঘটানো হয় তখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনও ফরহাদ মজহারই তার গর্ভপাত ঘটানোর সমুদয় টাকা পরিশোধ করেন। প্রথম গর্ভপাত ঘটানো হয় মালিবাগের একটি ক্লিনিকে। কিন্তু ৪ মাস আগে আবারও ফরহাদ মজহারের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে অর্চনা গর্ভবতী হন। যেদিন অপহরণের নাটক সাজানো হয় তার দুই-তিনদিন আগে ফরহাদ মজহারকে মোবাইলে ফোন করেন অর্চনা। অর্চনা জানান, আপনার (ফরহাদ মজহার) সম্পর্ক আমার পেটে। ফরহাদ মজহার তখন অর্চনাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিলেন, এই বার তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখানো হবে। ডাক্তার দেখানো ছাড়াও তার গুরুতর অসুস্থ বাবার চিকিৎসার কথাও বলেছিলেন অর্চনা। কিন্ত ফরহাদ মজহারের কাছে এত টাকা নেই। তার সব টাকা স্ত্রী ফরিদা আখতারের কাছে। অর্চনার পরকীয়ার টানে টাকা যোগাড় করতে গিয়েই অপহরণের নাটক সাজাতে গিয়ে এখন নিজেই ফেঁসে যাচ্ছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একজন কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদ মজহারের অপহরণের সাজানো নাটকের দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া মোবাইল ফোনের কললিস্ট, ভয়েস রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, সিসি টিভির ফুটেজসহ যেসব প্রযুক্তিগত তথ্য-উপাত্ত আছে তা তো আর কেউ নতুন করে তৈরি করে গল্প বানাতে পারবে না। এসব ঘটনার ছবি, কণ্ঠস্বর তো খোদ ফরহাদ মজহার, তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও ভক্ত অর্চনা রানীর। তারা তাদের নিজের কণ্ঠস্বরের রেকর্ড, ছবির ভিডিও মিথ্যা বলবে কিভাবে? কিভাবে বলবে পুলিশ এসব তৈরি করেছে? তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, অর্চনা রানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেই অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন ফরহাদ মজহার। এটা তার স্ত্রী ফরিদা আখতার নাও জানতে পারেন। সে জন্যই হয়তো ফরহাদ মজহার অপহরণের এই নাটক সাজিয়েছেন। গত ৩ জুলাই ভোর ৫টায় শ্যামলীর নিজ বাসা থেকে বের হয়ে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হয়ে অপহরণের ঘটনা সাজান। এরপর মোবাইল ফোন থেকে বেশ কয়েক দফায় স্ত্রী ফরিদা আখতারের কাছে ফোন করে অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দাবির ঘটনাও সাজিয়েছেন। তদন্তে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অপহরণ ঘটনার পর থেকে উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীর সঙ্গে ১০ বার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। তার অন্য একটি নম্বর থেকে তিনি অপর এক নারীর সঙ্গে ৬ বার কথা বলেছেন। তার কাছ থেকে ওই মোবাইল ফোনে দুটি এসএমএসও এসেছে। দ্বিতীয় নম্বরটির সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ওই ফোনের মালিক ঢাকার ভাটারায় আছেন। পরে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করতে গিয়ে দেখেন, ফোনের মালিক চট্টগ্রামে চলে গেছেন। পরে জানতে পারি, তিনি একজন নারী। তার নাম অর্চনা রানী। অর্চনা রানী ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলে থাকা অবস্থায় ফরহাদ মজহারের এনজিওতে কাজ করতেন। এতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। সম্পর্কের কারণে আগে একবার তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার তার গর্ভপাত ঘটানো হয়। অবৈধ সম্পর্কের কারণে দ্বিতীয়বার আবারও গর্ভবতী হন অর্চনা। অপহরণের নাটক সাজানোর আগের দিন গত ২ জুলাই অর্চনা আবার ফোন করেন ফরহাদ মজহারকে। অর্চনা তাকে (ফরহাদ মজহার) ফোন দিয়ে জানান, আপনার সম্পর্ক আমার পেটে। এতে ফরহাদ মজহার অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাবি। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এই তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। তদন্তে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমাদের আরও দু’একদিনের মতো সময় লাগবে। তবে ফরহাদ মজহার আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দী দিয়েছেন, তা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যে প্রযুক্তিগত ভিডিও ফুটেজ, সিসিটিভি ফুটেজ, কললিস্ট, এবং বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছি, তার সঙ্গে ওনার বক্তব্যের মিল নেই। আমরা তদন্তে প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছি। এই অপহরণের সাজানো ঘটনার সকল প্রযুক্তিগত তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, আলামত হস্তগত হয়েছে। ফরহাদ মজহার, তার স্ত্রী ফরিদা আখতার, তার ভক্ত অর্চনা রানীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
×