ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুবেল রেহান

বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে স্মৃতিতে সোমেস্বরী

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৪ জুলাই ২০১৭

বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে স্মৃতিতে সোমেস্বরী

নবেম্বরের শেষ, মধ্যরাত। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন। গন্তব্য ময়মনসিংহ হয়ে সুসং দুর্গাপুর। ময়মনসিংহ পৌঁছালাম ভোর ৪টায়। দু’ঘণ্টা যাত্রাবিরতি। তারপর আবার ট্রেনে চড়ে বসা। এবার নেত্রকোনা। নেত্রকোনার জারিয়া স্টেশনে যখন নামলাম তখন কুয়াশা চাদরে জড়ানো জনপথ আরমোরা ভেঙ্গে জেগে ওঠেছে কেবল। জারিয়া বাজার থেকে দুর্গাপুর পথে চোখে পড়ে কংশ নদী। এই নদীর পাশেই অটো স্টেশন। দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি অটো থেকে বেছে নিলাম আমাদের গন্তব্য দুর্গাপুরের অটো। পথ বেশি নয়, ৮-১০ কিলোমিটার। পথে চোখে পড়ে অসংখ্য ছোটবড় হাওড়। হাওড়ের পানিতে ঝিলিমিলি খেলছে সূর্য্যকিরণ। দিগন্তে ছোট ছোট বাড়িঘর। স্কুলব্যাগ কাঁধে বাচ্চারা যাচ্ছে স্কুলে। কোলাহলে মুখরিত সকাল। ৩০-৪০ মিনিটে পথের দুরত্ব পেরিয়ে পৌঁছলাম দুর্গাপুর জেলাপরিষদ ডাকবাংলোতে। ঘড়ির কাটা তখন সকাল ১০টায়। আপাত অবস্থান ওই ডাকবাংলোই। এখানেই ঘন্টা দু’তিনেকের ছোট্ট বিশ্রাম। ডাকবাংলো থেকে বেরিয়েই দুর্গাপুর বাজার। বাজারের কোলঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে এক নদী। নদীর নাম সোমেস্বরী। নিমিষেই ছুয়ে দিলো মনকে। সবুজ-সতেজ প্রকৃতির ছোঁয়া দিতেই যেন প্রস্তুত স্বপ্নভূমি-উপজাতি অধ্যুষিত নেত্রকোনার সোমেস্বরী নদী। ওপারে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়। যেন দাঁড়িয়ে আছে আকাশের বুকচিরে। না জানি কত যুগের মিতালি। সবুজ সুনীল আঁকাবাঁকা পথে যতই অগ্রসর হই মন হারিয়ে যায় নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যে। পাহাড়ের চুড়োয় চুমু খাওয়া বাতাস। সেও সাহস পায় না প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভাঙতে। মন বলে নিস্তব্ধতা হিরন্ময়। পাহাড়ী নদী সোমেস্বরী। অববাহিকায় যুগ যুগ ধরে বসবাসরত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত উপজাতি। রয়েছে খনিজ সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। শীতের সোমেস্বরীতে পানি কম বিধায় স্রোতও নেই তেমন। এর এক পাশ ঘিরেই চলছে বালু তোলার কাজ। বালু উত্তোলনে ব্যস্ত অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ। বাজারের পাশঘেঁষে নদীতে বাঁধ দিয়ে যুক্ত চরাঞ্চল। এবার ওপারে যাত্রা সেই বাঁধের ওপর দিয়েই। ওপারে প্রকৃতি যেন রূপের হাট বিছিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মনে হয় গারো পাহাড় চুমু খেয়েছে নিলিমায়। মন চাইলো ছুঁয়ে দেই সে নিলিমা। নদীর মাঝখানটাতে সাদা কাশবন। গারো পাহাড়ের কন্যা সোমেস্বরীর তলপর্যন্ত দেখা যায় এক বর্ষা বাদে অন্য যে কোন ঋতুতে। বর্ষায় সোমেস্বরীর অন্য রূপ। সে তখন অহঙ্কারী পাহাড়ী কন্যা। উপচেপড়া যৌবন যেন বান ডাকে তার দেহে। দুর্বিনীত কিন্তু সৌন্দর্যে অনন্য। সে এক ভিন্ন সোমেস্বরী। নদীর তলে থাকা বালুকনা চিকচিক করে জ্বলছে সূর্য্যরে কিরণে। নদী তখন টানছে আমায়। লোভ সামলাতে না পেরে নেমে পরলাম নদীতে। হাঁটু অব্দি পানি ঠেলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি সোমেস্বরীর বুকে। হঠাৎ দেখি ছোট ছোট মাছ এসে ঠোকর কাটছে পায়ে। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, সূর্য্যরে আলো পড়ে মাছগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন সুবিশাল এক একুরিয়ামের পশলা সাজিয়ে রেখেছে সোমেস্বরী। নৌকা চলাচল তেমন একটা চোখে পড়ে না এ সময়টাতে। তবে নৌকা ভ্রমণ করতে চাইলে দুর্গাপুর বাজারের কাছে ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করা যায়। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর একটি নৌকা দেখতে পেলাম। ওপারে যাবার কথা বলতেই রাজি হলেন নৌকার মাঝি। নৌকাতে বসেই তার সঙ্গে কথা হলো। খড় সংগ্রহ করতে তিনি নদীর মাঝে চরে আসেন ছেলেকে নিয়ে। তার কাছ থেকেইে জানা গেল সোমেস্বরী নদী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও নদী নিয়ে কল্পকাহিনী। সোমেস্বরী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার। গড় প্রসস্থ ১০৩ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ৫০ কিলোমিটার। নদীটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহার থেকে উৎপত্তি। কারও কারও মতে, এ নদীর আদি নাম ছিল নাকি সিমসাং। কথিত আছে কোন এককালে এই অঞ্চলটা দখল করেছিলেন সোমেস্বর নামের একজন। যার নামেই পরে নামকরণ হয় এই নদীর। অতপর পা রাখলাম নদীর ওপারে। এখানে বালুচর থেকে সামনে তাকালে পাহাড়ের নিচে একটি গ্রাম দেখা যায়। অবস্থান বিজয়পুরের মধ্যে। একটু এগিয়েই দেখা মিলল কয়েকজন মিলে নদীর কিনারায় ব্যস্ত কয়লা উত্তোলনে। কথা বলে জানা গেল কয়লা তোলাই তাদের একমাত্র পেশা। সারাবছরই সোমেস্বরীর চরে কয়লা তোলেন। শত কষ্টের মধ্যেও এ কাজ করেন তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই। দিনের যে কোন সময়ই গেলে দেখা মিলবে এ দৃশ্য। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম দেখার জন্য। প্রথমে কেউ একজন কোদাল দিয়ে গর্ত খোঁড়েন। এরপর কয়লার সন্ধান মিললে কয়েকজন একসঙ্গে কয়লা ওপরে তুলে আনেন। এছাড়াও চোখে পড়ে কেউ কেউ সরাসরি নদীতে নেমে জালি বা ছাকনির সাহায্যে কয়লা তুলে আনছেন। সকাল থেকে কয়লা তুলে তা একটা নির্দিষ্ট স্থানে জমা রাখেন আর বিকেলবেলা তা পরিষ্কার করেন। অতপর তা নিকটস্থ বাজারে পাইকারিদের কাছে বিক্রি করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের বিখ্যাত চিনামাটি এই বিজয়পুর থেকে সংগৃহীত হয়। এবারের যাত্রা গারো পাহাড়ের দিকে। বিস্তৃত খোলা আকাশ, চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা। নীরব, নিস্তব্ধ এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ২০ মিনিট পর উঠলাম বেঁকে চলা এক কাঁচারাস্তায়। কাছেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বাংলাদেশের এ অঞ্চলটা বিজয়পুরের মধ্যে পড়েছে। এখানে আছে ছোটবড় অনেক পাহাড়। সবগুলোই পাথুরে পাহাড়। এসব পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে হাজার প্রজাতির বনজ ঔষধি গাছ। টিলা-পাহাড় ঘুরতে ঘুরতে, সেখানকার অধিবাসীদের আতিথ্য গ্রহণ করে আপনি বুঝতে পারবেন ওরা কত সহজ-সরল জীবনযাপন করে। গারো, হাজং, কোচ, হদি, ভালু ও কানাই প্রভৃতি উপজাতির বাস এ অঞ্চলে। ধর্মে-বর্ণে ওরা সম্পূর্ণ আলাদা। বেশিরভাগ গারো উপজাতি পাহাড়ে বসবাস করে। আর সমতলে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর নাম হাজং। সোমেস্বরীকে পেছনে রেখে সামনে তাকাই। অবারিত প্রকৃতি। যেখানে মানুষ তুলেছে সীমানা দেয়াল। সামনেই ভারত সীমান্ত। মন ছুটে যায় কিন্তু কাটা তার বাধা হয়ে দারায়। এদিকে সূর্য্য জানান দিচ্ছে তার বিদায় বার্তা। মন না চাইলেও ফিরতে হয়। পাহাড়ী এলাকা বলেই ঠাণ্ঠাটাও বেশ নেমে এসেছে। কুয়াশা ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে পাহাড়গুলো। খানিক দূরে জ্বলে উঠেছে ভারতে-বাংলাদেশ সীমান্তের ল্যাম্পোস্টগুলো। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার থেকে ফিরছে স্থানীয় বাংলাদেশীরা। ওই বাজারেই তারা নিয়মিত যায় বিকিকিনি করতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফিরছি গন্তব্যে, সেই চির পরিচিত নগর ঢাকায়। পেছনে পড়ে রয় আচল বিছিয়ে সোমেস্বরী আর পাহার। জানি আমাকে ফিরতে হবে। কিভাবে যাবেন- দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেত্রকোনায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে দুর্গাপুরও যাওয়া যায় বাসে করে। ঢাকা থেকে সড়কপথে নেত্রকোনার দূরত্ব প্রায় ১৭৮ কিলোমিটার (ঢাকা-ময়মনসিংহ ১২০ কিলোমিটার, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা : ৬৮ কিলোমিটার)। রেল পথে : রেলপথেও আপনি যেতে পারেন সুসং-দুর্গাপুর। সেক্ষেত্রে সহজে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে প্রথমে ময়মনসিংহ যাবেন। ওখানে গেলে লোকাল ট্রেনযোগে নেত্রকোনা যাবার কোন ট্রেনে চড়লেই হবে। তবে নেত্রকোনা যাবার দরকার নেই। তার আগেই জারিয়া নামক স্টেশনে নেমে সেখান থেকেই অটো অথবা বাইকে চরে সরাসরি যাওয়া যায় দুর্গাপুর।
×