ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিনি কি তার কোন ঘনিষ্ঠজনের ফাঁদে পড়েছিলেন?

দু’এক দিনেই ফরহাদ মজহার অপহরণ রহস্য উদ্ঘাটন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৯ জুলাই ২০১৭

দু’এক দিনেই ফরহাদ মজহার অপহরণ রহস্য উদ্ঘাটন

শংকর কুমার দে ॥ কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার অপহরণ রহস্য দু’এক দিনের মধ্যেই উদ্ঘাটন হতে পারে। তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। প্রতীয়মান হচ্ছে, পূর্বপরিচিত ঘনিষ্ঠজনদের ট্র্যাপে পড়েছিলেন তিনি। যাদের ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি তাদের পূর্বপরিচিত। বিশ্বাস করে তাদের ডাকে তিনি অত ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তারপর কৌশলে মাইক্রোবাসে তুলে তাকে ঢাকা থেকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়। যারা তাকে ট্র্যাপে ফেলেছিলেন এমন দু’একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ মুখ খুলছে না। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফরহাদ মজহার সাধারণত ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন না। কিন্তু সোমবার ভোর পাঁচটায় তিনি ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরে যান। তিনি জবানবন্দীতে বলেছেন, ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। তিনি সত্য গোপন করেছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। কারণ যারা তাকে ঢাকা থেকে খুলনা নিয়ে গেছে তারা জানবেন কি করে যে তিনি এত ভোরে ওষুধ কিনতে আসছেন? এতেই তদন্তকারীদের কাছে মনে হচ্ছে, যারা তাকে এত ভোরে বাড়ি থেকে বের করে এনেছে তারা তার পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন। শুধু তাই নয়, তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে ব্যাগ, পাঞ্জাবি, মোবাইল ফোনের চার্জার, নগদ টাকা নিয়ে বের হয়েছিলেন। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। তিনি বাসা থেকে একা বের হয়েছিলেন, নাকি কেউ তাকে ডেকে নিয়েছে, সেটিই মূল তদন্তের বিষয় বলে জানান তিনি। শনিবার কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাদকবিরোধী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ফরহাদ মজহার অপহৃত হয়েছেন এখনও পর্যন্ত এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিস্তারিত তদন্ত করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেছিলেন, ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর এটা ‘অপহরণের নাটক’ বলে মনে হয়েছে তাদের। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফরহাদ মজহার ঢাকা থেকে খুলনায় পৌঁছান সন্ধ্যা সাতটায়। খুলনায় পৌঁছানোর পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা তিনি একাই খুলনায় ঘোরাফেরা করেন। তারপর হোটেলে খাওয়া দাওয়া করেন একাই। তারপর তাকে টিকেট ধরিয়ে দেয়া হয়। একাই তিনি বাস কাউন্টারে তার মোবাইল ফোনে নিজের চার্জার দিয়ে ফোনে চার্জ দেন। খুলনা থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে যশোরের নওয়াপাড়ায় আসার পর রাত সাড়ে এগারোটায় তাকে উদ্ধার করা হয়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তিনি খুলনা ও যশোরে ছিলেন একাই। তিনি সত্যি যদি অপহরণের শিকার হন তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে অপহরণকারীদের পালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা তাকে খুলনা নিয়ে গেছে তারা পালানো তো দূরের কথা, ফরহাদ মজহারকে বাসের টিকেটও কেটে দিয়েছে। ফরহাদ মজহারের মামলায় বলা হয়, সেদিন ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ফরহাদ মজহারকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন ফরিদা। সকাল পাঁচটা ২৯ মিনিটে তিনি স্বামীর ফোন থেকে কল পান। ফরহাদ মজহার তাকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে’। এরপর ফোনটি কেটে যায়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতেই সারাদিনে ফরহাদ মজহারের ফোন থেকে আরও চারবার কল পান ফরিদা। সেসব ফোনালাপে ফরহাদ মজহার জানান, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। ওইদিন রাতে যশোরের বাসে ফরহাদ মজহারের খোঁজ পাওয়ার আগে খুলনা নিউমার্কেট এলাকার ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আবদুল মান্নান দাবি করেন, তার রেস্তরাঁয় ফরহাদ মজহার ভাত খেয়েছেন। টিভিতে ফরহাদ মজহারের ছবি দেখে তিনি র‌্যাবকে খবর দেন। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যশোরের নওয়াপাড়ায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি বাস থামিয়ে শেষের সারির আসনে ফরহাদ মজহারকে পায়। তারপর তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠানো হয়। এসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও পূর্বপরিচিত দু’একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তারা ফরহাদ মজহার মামলার বিষয়ে কাউকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এমন কথা অস্বীকার করেন তিনি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফরহাদ মজহারের পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ দু’একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে নাম বলা যাচ্ছে না। মামলায় বলা হয়, সোমবার ভোরে শ্যামলীর বাসা থেকে বের হয়ে যান ফরহাদ মজহার। এরপর থেকে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশের কাছে জবানবন্দীতে ফরহাদ মজহার বলেন, তিনি শ্যামলীর বাসা থেকে ওষুধ কিনতে বের হয়ে অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। অপহরণকারীরা তাকে মারধর করেন। খুলনায় মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত তার চোখ বাঁধা ছিল। উদ্ধারের সময় সঙ্গে পাওয়া ব্যাগটিও তিনি বাসা থেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। খুলনা থেকে ঢাকায় আসার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে ফরহাদ মজহারকে প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ ও আদালতের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে তার কক্ষে স্বজন ও বন্ধুরাও তার কাছে যেতে পারছেন না। এমনকি তার স্ত্রী ও স্বজনরাও এই বিষয়ে কথা বলছেন না। মেয়ে সমতলী হক ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদ মজহারকে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ও পরে তিনি কয়টা ফোন করেছেন এবং তাকে কে বা কারা কতটা ফোন করেছেন তার কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তার বাসা থেকে খুলনা, যশোর যেখান অবস্থান করেছেন সেখানকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার সঙ্গে থাকা ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার ও একটি পোশাক ছিল। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার কাছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা ছিল। এ থেকে অনুমান করা যায় বাসা থেকে বের হওয়ার পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেন তাকে অপহরণ করা হয়েছে, অপহরণে সহযোগিতা করেছে কারা, এখন সে রহস্য উদ্ঘাটিত হতে যাচ্ছে।
×