ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপরিকল্পিত নগরায়ণে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই

দুদিনের বৃষ্টিতে ডুবেছে রাজধানী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৬ জুলাই ২০১৭

দুদিনের বৃষ্টিতে ডুবেছে রাজধানী

শাহীন রহমান ॥ একটু বৃষ্টি হলেই বা বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি রাজধানী ঢাকার চিরাচরিত ঘটনা। গত দুদিনের বৃষ্টিপাতেও রাজধানীর মতিঝিল, শান্তিনগর বিজয়নগর কাওরান বাজারে সৃষ্টি হয় ব্যাপক জলাবদ্ধতা। ফলে লোকজনকে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার এই জলাবদ্ধতা অনেকটাই মনুষ্যসৃষ্ট। অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাল জলাশয় ভরাট, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা এবং বছর জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কারণেই রাজধানীর জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বর্তমানে একটু বৃষ্টি হলেই যে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা পুরোপুরি নিরসন করাও সম্ভব নয়। প্রকৃতিতে এখন চলছে বর্ষাকাল। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবমতে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টিপাতের আধিক্য অনেক বেশি। বছরের শুরু থেকেই প্রতিমাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর আধিক্যের কারণে গত দুদিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিúাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদফতর রাজধানীতে ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এতেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে জনগণকে ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়েতে হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে বুধবার সকাল থেকে মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ মোড়, শান্তিবাগ, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ বৌদ্ধ মন্দির, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনের রাস্তায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে জলাবদ্ধতার ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন স্থানীয়রা। জমে থাকা পানির কারণে গাড়ি চলাচলে মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হয়। পথচারীরাও পড়েন চরম বিপাকে। এছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। সকালে গাবতলী এলাকায় দেখা যায় রাস্তায় খানখন্দে পানি জমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী ফেরত মানুষকে সকালে বাস থেকে নেমে বৃষ্টির মধ্যে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। সড়কগুলোতে বৃষ্টিতে জমে থাকা পানির জন্য রাজধানীবাসীর চলাচলে চরম সমস্যা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় যানজটেরও সৃষ্টি হয় বিভিন্ন এলাকায়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সর্বত্র একনাগাড়ে না হলেও ঢাকাসহ সারাদেশেই কমবেশি বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও হাল্কা আবার কোথাও ভারি থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত। তারা জানায়, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশে আগামী দু’দিন এভাবেই বৃষ্টি হতে পারে। হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ভারি - অতিভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারি বর্ষণের কারণে দেশের পাহাড়ী অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কার কথা জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে আর হাওয়া অফিস। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, দেশের আকাশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয়। আগামী দুই দিন দেশব্যাপী থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হবে। ৭২ ঘণ্টা পর আবহাওয়ার উন্নতি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। অথচ প্রথম থেকে নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলেন, বছরের পর বছর এ বিষয়ে কথা হলেও রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার কোন সুরাহা হচ্ছে না। একটু ভারি বৃষ্টি হলেই পানির নিচে চলে যায় সব। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোন পথই খোলা নেই। ফলে জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। ময়লা আবর্জনাও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রাজধানীতে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হয়। এখান থেকে কঠিন বর্জ্য সরাসরি ড্রেনে গিয়ে পড়ে। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই আবর্জনার কারণে পানি আটকে গিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ছয় হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। গত ১০ বছরে এ মহানগরীতে বর্জ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১০ বছর আগে দৈনিক তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ হারে অপসারিত হতো এক হাজার ৩৭৬ টন। এখন দৈনিক ছয় হাজার ১১০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে অপসারিত হয় চার হাজার ৫৮২ টন? এইসব বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ছাড়াও কঠিন বর্জ্য সরাসরি ডাম্পিংয়ে নেয়া হয়। তবে বৃষ্টিতে পানি জমলে কঠিন এবং তরল বর্জ্য একাকার হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় না। আর এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ মিলি মিটার বৃষ্টির রেকর্ড আছে। এবার বর্ষার আগে থেকেই বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। আর সামনে পড়ে আছে পুরো বর্ষা ঋতু। তাই আগের হাঁটু পানির জলাবদ্ধতা এখন কোমড় পানির দিকে যাচ্ছে। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকার সড়কে নৌকা চলে। সড়ক পথে যানবাহনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র ভরসা রিক্সা। তাও পানিতে তলিয়ে যাওয়া খানাখন্দে ভরা সড়কে চলতে গিয়ে যাত্রীসহ প্রায়ই উল্টে যায়। কাদাপানিতে একাকার হয়ে যান রিক্সাযাত্রী। বর্ষার আগে খোঁড়াখুঁড়ি নতুন নয়। প্রতিবছরই বর্ষায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। এই খোঁড়াখুঁড়ি বৃষ্টিতে নতুন ভোগান্তি যোগ করে। বর্তমানে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত করতে নগর জুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এই খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বৃষ্টিতে নগরবাসীকে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকায় এক সময় খালের সংখা ছিল ৪৩টি। বর্তমানে পানি নিষ্কাশনের ড্রেন ছাড়া কোন খালের অস্তিত্ব রাজধানীতে নেই। সবগুলো খাল, পুকুর, জলাশয় দখল করা হয়েছে। বর্তমানে নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। খাল নদী নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় কারণে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সর্বোপরি তারা উল্লেখ করেছেন অপরিকল্পিতভাবে বক্সকালভার্ট নির্মাণ এবং প্রয়োজনের তুলনায় এসব বক্স কালভার্ট সরু হওয়ায় প্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। বিআইডব্লিউটিএর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, পানির ধর্মকে অস্বীকার করে ঢাকা শহর থেকে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না। পানি নিচের দিকে যায়। যেতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ করে অন্য কোন ব্যবস্থায় এই জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন। তিনি বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট পানি যেতে তো সময় লাগে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ঢাকা শহরের জিওগ্রাফিক ম্যাপ আছে। প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের হিসাব আছে। কী পরিমাণ বৃষ্টিতে কত দ্রুত পানি নিষ্কাশন করলে পানি দাঁড়াতে পারবে না, সেই হিসাব করে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ঢাকার চারপাশে নদী রয়েছে। থাইল্যান্ডে শহরের ভিতরে ওয়াটার বোট চলে। আমাদেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। শহরের নদী-খাল ভরাট করে আমরা রাস্তঘাট বানিয়েছি। ফলে এখন জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট সিস্টেম এরইমধ্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। পাম্পের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পানি নিষ্কাশনের চিন্তা সঠিক নয়। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার আগে ভাবতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
×