ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের আপীল খারিজ ॥ মূলে ফেরা হলো না

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৪ জুলাই ২০১৭

সরকারের আপীল খারিজ ॥ মূলে ফেরা হলো না

আরাফাত মুন্না ॥ বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ই বহাল রেখেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীল আবেদন খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপীল বেঞ্চ সোমবার এ রায় দেন। এদিকে, এ রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সংবিধানের মূলে ফিরে যাওয়ার যে অভিপ্রায় ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা যেতে পারেনি। এতে আমি হতাশ, দুঃখিত। অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রিট আবেদন দায়েরকারীদের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আজ ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে আপীল বিভাগ। এ রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। রায়ের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, আমার কাছে সব সময় প্রশ্ন থাকবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যেটা ছিল, সেটা সামরিক সরকার সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আনার পর তা আবার সংসদ পুনঃস্থাপন করে। সেটা কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থী হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরই এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। অন্যদিকে রায়ের পর মিশ্রপ্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আইনজীবীরা। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করেছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। ‘সরকার বনাম এ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ শিরোনামে থাকা আলোচিত এই মামলা সোমবার রায়ের জন্য আপীল বিভাগের ১ নম্বর বেঞ্চের কার্যতালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে ছিল। সে অনুযায়ী সকাল ৯টায় আদালত বসার পর প্রথমেই এই রায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিচারপতিরা এজলাসে আসেন এক ঘণ্টা ২৫ মিনিট দেরিতে। জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্য বিচারপতিরা আসার পর ১০টা ২৬ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, রায়টি সর্ব সম্মতিক্রমে দেয়া হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করা হলো। সুপ্রীমকোর্টের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে সোমবার সকাল ৮টা থেকেই রায় নিয়ে বৈঠকে বসেন বিচারপতিরা। এ জন্যই এজলাসে আসতে বিচারপতিদের দেরি হয়। বৈঠকের জন্য সকাল ৮টার আগেই আপীল বিভাগের সাত বিচারপতি আদালতে এসে উপস্থিত হন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। প্রধান বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রিটকারীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেয়ার পর আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। পাশাপাশি এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের ১০ আইনজীবীর বক্তব্যও শোনে আপীল বিভাগ, যাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ পায়। হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল, সংসদে হয়েছিল ওয়াকআউট। অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি আবার হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান জানায়। সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটির আপীল শুনানি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে করার জন্য এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের চাপাচাপিতে আদালতেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার উত্তপ্ত বাগ্বিত-াও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। আমি হতাশ : এ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টে বাতিলের রায় আপীল বিভাগেও বহাল থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সোমবার সকালে রায় ঘোষণা হওয়ার পর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সংবিধানের মূলে ফিরে যাওয়ার যে অভিপ্রায় ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা যেতে পারেনি। এতে আমি হতাশ, দুঃখিত। তিনি আরও বলেন, এ রায়ের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগ স্বাধীন বলেই এ রায় দিতে পেরেছে। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ লোক তাদের প্রাণ দিয়েছিলেন এবং দুই লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সংবিধান সম্পর্কে বলেছিলেন, এই সংবিধান রক্তের অক্ষরে লেখা। আমাদের স্বপ্ন সংবিধানের মূল ধারাতে ফিরে যাওয়া এবং এই ধারাগুলোতে আমরা ফিরেও গিয়েছিলাম। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলার রায়ের মাধ্যমে। কিন্তু আমি অত্যন্ত হতাশ। আজকে এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যে আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬-তে ফিরে যাব, সেটা আর হলো না। আমি অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি। আদালতের রায়ের ফলে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে গেল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মতে পুনর্বহাল হয়নি। আমার মতে, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ সংসদ বাতিল করেছে সেটা আপনা-আপনি পুনঃস্থাপন হবে না। এই অবস্থায় শূন্যতা বিরাজ করছে। সংসদের কাজ তো আর কোর্ট করতে পারে না, বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ রায়ের পর এখন আপনারা কি করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রিভিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে হাইকোর্ট যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা ছিল খুবই ‘আপত্তিকর’। তা বাদ দেয়া উচিত, বলে মন্তব্য এ্যাটর্নি জেনারেলের। রায় ঐতিহাসিক : মনজিল মোরসেদ সোমবার রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে আপীল বিভাগ। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের হাতে নেয়া হয়েছিল। এ রায়ের মাধ্যমে তা খারিজ ও অকার্যকর হয়ে গেল। এখন থেকে বিচারকদের অপসারণে বিষয়ে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য চার দশক পর নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, ওই সংশোধনী যদি থাকত তাহলে বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। যার কারণে এ দেশের জনগণ ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতো। বিচার বিভাগের ইতিহাসে ও জনগণের স্বার্থে এক ঐতিহাসিক রায় দেয়া হলো। আমরা আইনজীবীরা সবাই খুশি। এ রায়ের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোন বিরোধ হবে কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে বলা আছে, আপীল বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা সবাইকে মানতে হবে। আপীল বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটি চূড়ান্ত। আপীল বিভাগ যখন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে, বিচার বিভাগের সঙ্গে জাতীয় সংসদের কোন বিরোধের সুযোগ নেই। বরং যে বিরোধ ছিল তা দূর হলো। সুপ্রীমকোর্টের রায় দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আপীল বিভাগের সাত বিচারপতি একমত হয়ে এ রায় ঘোষণা করেছেন। তবে হাইকোর্টের রায়ের মধ্যে কিছু শব্দের বিষয়ে এ্যামিকাস কিউরিরা (আদালতের বন্ধু) কিছু আপত্তি করেছিলেন। আদালত বলেছে, সেগুলো এক্সপান্স করে দেবেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন কীভাবে সংবিধান পরিপন্থী হয়, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। রায়ের বিষয়ে সাংবাদিকরা আইনমন্ত্রীর কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন। প্রশ্নটা ছিল, উচ্চ আদালতে যে রায় হলো, সেটায় সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ক্ষুণœ হলো কি না? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রায়ে ওনারা শুধু আপীল খারিজ করে দিয়েছেন। এখন এ প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে আমার মনে হয় পূর্ণাঙ্গ রায় যতক্ষণ না পর্যন্ত পড়ি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই কথার জবাব দেয়া যাবে না। তবে আমার কাছে সব সময় প্রশ্ন থাকবে যে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যেটা ছিল, সেটা সামরিক সরকার সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আনার পর তা আবার সংসদ পুনঃস্থাপন করে। সেটা কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থী হয়, আমি সেটা বুঝতে পারছি না। আমি অপেক্ষা করব পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর আমরা কী করব, তার সিদ্ধান্ত নেব।’ বিএনপি পন্থী আইনজীবীদের মিষ্টি বিতরণ ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করেছে বিএনপি পন্থী আইনজীবীরা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে। কিন্তু এই ক্ষমতা সংসদে নেয়ার জন্য ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। এ রায়ের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরে গেল। এতে সারাদেশের আইনজীবীরা খুশি হয়েছেন। তিনি বলেন, শুধু আইনজীবীরা নয়, যারা আইনের শাসনের বিশ্বাস করে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা সকলে খুশি হয়েছেন। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পেল। রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পেল। রাজনীতিবিদদের সুপ্রীমকোর্টকে নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক না। এই রায় না হলে বিচার বিভাগ রাজনীতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। যে দেশের বিচার বিভাগ যত শক্তিশালী সেই দেশের গণতন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা তত শক্তিশালী। সারাদেশের আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ এই রায়ে খুশি। এ রায় ঘোষণার পর ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, আমার পক্ষ থেকে দুই মণ মিষ্টি বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য আইনজীবীরা মিষ্টি আনার ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানান তিনি। আপীলের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৯৬ ধারাটি সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল’ অথরিটি বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রীম জুডিসিয়াল প্রভিশন ঢুকিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বরং আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গেছি।’ এই সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের মূল কাঠামোয় কোন পরিবর্তন হয়নি দাবি করে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘হাইকোর্ট ডিভিশন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন।’ অন্যদিকে শুনানিতে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সংবিধান তৈরির সময় বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল। পরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, তাতে পরিবর্তন আনেন। বিচারক অপসারণে অস্ট্রেলিয়া, নামিবিয়া, পাকিস্তান, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকার তথ্য তুলে ধরেন মনজিল মোরসেদ। তিনি যুক্তি দেখান, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার অধিকার সংরক্ষিত না থাকায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকলে তার রাজনৈতিক ব্যবহারের আশঙ্কা থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপীল বিভাগ আদালত বন্ধু হিসেবে যে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন, তার মধ্যে ড. কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি। কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেনÑ টি এইচ খান, এ এফ এম হাসান আরিফ, এম আমীর-উল-ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মতামত দেননি। তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রশ্ন রেখেছিলেন, কোন বিচারককে অপসারণের প্রক্রিয়ার সময় যদি সংসদে কোন দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে তখন কী হবে? এর উত্তরে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা মতিন খসরুর বক্তব্য ছিল, ‘সেটা পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে।’ হাইকোর্টের রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল, ‘বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোন কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একই সঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (এ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হল। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।’ বিচারক অপসারণ : বার বার ক্ষমতা বদল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোন পরিবর্তন আসেনি। ফিরে দেখা ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করেন। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।
×