ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

পাহাড়ী ঢলে তিন জেলায় দুই লাখ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩ জুলাই ২০১৭

পাহাড়ী ঢলে তিন জেলায় দুই লাখ পানিবন্দী

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সিলেট, রংপুর ও নীলফামারীতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দুই লাখেরও বেশি মানুষ। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ধানী জমি। এছাড়া পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। জানা গেছে, বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সিলেটের ৬ উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই সকল এলাকায় তিন হাজার হেক্টর আউশ ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা আক্রান্ত হওয়ায় ৬ জেলায় ১৭৪ স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ভারতের মেঘালয় ও অসম রাজ্যে টানা বৃষ্টির কারণে বরাক নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় বরাকের শাখা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর পানি তীর উপচে গ্রাম এলাকায় প্রবেশ করছে। ফলে নদী অববাহিকায় গ্রামগুলো তলিয়ে গেছে। এপ্রিলে অতিবৃষ্টি আর বন্যায় হাওড়ে ফসলহানির পর আবার নতুন দুর্যোগে দিশেহারা হয়ে পড়েছে এলাকার মানুষ। প্রশাসন থেকে দুর্গতদের মাঝে দ্রুত সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রবিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক বৈঠকে এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে জানানো হয়, বন্যার কারণে জেলার ছয় উপজেলায় ১৬১ প্রাথমিক ও ১৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত। ঘরবাড়ি, দোকানপাট পানিতে তলিয়ে গেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে শতাধিক দোকানপাটে পানি প্রবেশ করেছে। সড়কে নৌকা দিয়ে চলাচল করছে মানুষ। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দুর্গত এলাকায় ১২৮ মেট্রিকটন চাল ও দুই লাখ ৭৮ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে আরও ত্রাণ ও সাহায্য দেয়া হবে। রংপুরে পানিবন্দী ৩ হাজার পরিবার উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও অব্যাহত বৃষ্টিতে শুক্রবার রাত থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তিস্তাপারের মানুষজন। জানা যায়, তিস্তার পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের রাজবল্লভ, গাউছিয়ারবাজার, রমাকান্ত; মর্ণেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, নরসিং, ছোট রূপাই; লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের জয়রাম ওঝা, কালীরচর, চর ইচলি, চর শংকরদহ; গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের ধামুর চর; কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনা; নোহালী ইউনিয়নের বাগডহরা, চর নোহালী, মিনার বাজারসহ তিস্তা নদীসংলগ্ন এলাকার ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান দোলাপাড়া, হাজীপাড়া ও কোলকোন্দ ইউনিয়নের সাউদপাড়া এলাকায় নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আলমবিদিতর ইউপি চেয়ারম্যান আফতাবুজ্জামান জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকান দোলাপাড়ায় ১০টি পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে নোহালী ইউনিয়নের প্রায় ৫শ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী শহিদুর রহমান বলেন, রবিবার সকালে ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সে.মি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও এখন কমতে শুরু করেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র রায় পানি বৃদ্ধির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা পানিবন্দী পরিবারগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিস্তার জল বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চল প্লাবিত এবং নিচু অঞ্চলের বসতভিটায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। তিস্তা নদীর বন্যা উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত। রবিবার তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার এই পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ হলেও পরে তা ৫ সেন্টিমিটার কমে আসে। রবিবার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে সকাল ৬টা থেকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০ মিটার) ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সব (৪৪টি) জল কপাট খুলে রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। উজানের ঢলে তিস্তার বন্যায় বিশেষ করে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার গোলমু-া, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার ২৫টি চর ও গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের ঘরবাড়িতে বানের পানি প্রবেশ করেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা উঁচুস্থানসহ তিস্তার ডানতীর বাঁধে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তিস্তা অববাহিকার চর ও গ্রামে বসবারত পরিবারগুলো জানায়, এলাকায় বৃষ্টিপাত নেই। অথচ উজানের দেশ ভারত হতে গভীর রাত করে এখন ঢল নেমে আসছে। এতে আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। ফলে রাতে ঘুমাতেও পারে না তারা। পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, তার এলাকার ঝাড়শিঙ্গ ও পূর্বছাতনাই মৌজার প্রায় ১ হাজার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অপরদিকে টেপাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন বলেনÑচরখড়িবাড়ি মৌজা ও দোলাপাড়া এলাকার বসতবাড়ি আবাদি জমি তলিয়ে যাওয়ায় দেড় হাজার পরিবারকে বাঁধে আশ্রয় নিতে হয়েছে। মৌলভীবাজারে ১৮৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার থেকে জানান, জেলায় তৃতীয় দফা বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। গত ২দিন উজানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনও জেলা সদরের সঙ্গে বড়লেখা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলায় মোট ১৮৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য এ পর্যন্ত খোলা হয়েছে ২৯ আশ্রয় কেন্দ্র। অপরদিকে নতুন করে রাজনগর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুড়া, নাজিরাবাদ ও গিয়াসনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। রমজান ও ঈদের টানা ছুটির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও শিক্ষার্থীরা যেতে পারেনি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল আলিম জানান, জেলায় মোট ১৪২ প্রাথমিক স্কুল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হাওড়পারের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং তলিয়ে যাওয়ায় জেলায় ৪২ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। পানি কমলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম আবার শুরু হবে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে কারণে হাকালুকি হাওড়ের পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে না পেরে উজানে বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মার্চ ও এপ্রিলের বন্যার পর এটি মৌলভীবাজারে ৩য় দফা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। এদিকে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওড়, নদী, খাল-বিল ও জলাধারগুলো ভরাট ও দখল হয়ে যাও্য়ায় পানি ধারণ ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বন্যা এমন রূপ নিয়েছে। জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলায় সর্বশেষ ২৯৪ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ১০ লাখ টাকা এবং ৫৯ হাজার ২০০ ভিজিএফ কার্ডের অনুকুলে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন ধাপে ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছাড়াও তিনমাসের জন্য ৫ হাজার ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এদিকে জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম রবিবার কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শনসহ বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল জিআর চাল, জিআর ক্যাশ ছাড়াও ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার Ñচিড়া, চিনি, টোস্ট বিস্কুট ও মুড়ি। অপরদিকে রবিবার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছে কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের একটি টিম। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে এ টিমে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, হুইপ মোঃ শাহাব উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুল শহীদ এমপি, সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ, আব্দুল মতিন এমপি, মৌলভীবাজারের পৌর মেয়র ফজলুর রহমান ও জেলা যুবলীগ সভাপতি নাহিদ আহমদ।
×