ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

করতোয়ার মতো ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব থাকছে না

বৃষ্টি আর ঢলে সামান্য ভরে ওঠে- তারপর মরা গাঙ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২ জুলাই ২০১৭

বৃষ্টি আর ঢলে সামান্য ভরে ওঠে- তারপর মরা গাঙ

সমুদ্র হক ॥ বর্ষা মৌসুমেও সেই নদীকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। সামান্য বৃষ্টির পানিতে ভরে ওঠে। মৌসুম শেষের আগেই শুকনা। বড় নদীগুলোতে কিছুটা ঢল আসে। কখনও বন্যা হয় নিচু এলাকায়। তারপর বয়ে আসা পলি গভীরতা কমিয়ে দেয়। নদী শুকিয়ে যায়। ছোট নদীগুলোর অস্তিত্বই আর থাকছে না। সড়কপথে চলতে গেলে চোখে পড়ে কোন ছোট সেতু। সেতুর নিচে পানিপ্রবাহ নেই। শুকনা ঠাঠা। বর্ষাকালেও পানি ভরে না। কংক্রিটের সেতুর প্রবেশপথে রেলিংয়ের ওপর লেখা থাকে কোন নদীর নাম। তবে নদীর অস্তিত্ব নেই। নদীর শুধু নামটি ধরে রেখেছে সেতুটি। এমনই কত নদী শুকিয়ে মাঠ-ভূমি হয়েছে আর কত নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই নদী দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা- এ তিনটি নদী অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। উজানে যে নদী গঙ্গা, এ দেশে তা পদ্মা। উজানের ব্রহ্মপুত্র এ দেশে স্রোতধারায় বেশকিছু নাম দিয়েছে। যমুনা নদী অনেক শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে। এ ছোট নদীগুলোর অনেক নাম। এ নদীগুলো প্রায় ৯ দশমিক ৬০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রবাহিত, যার মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে আছে বাংলাদেশ। এসব নদীর জলপ্রবাহের ৮০ শতাংশ আসে বর্ষা মৌসুমের চারটি মাসে (জুন-সেপ্টেম্বর)। প্রতি বছর এরা বহন করে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পলি। ছোট নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো এই পলি। ভূগোলবিদদের মতে, প্রত্যেক নদীর পলি বহনের নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতার বেশি পলি বহন করতে হলে অথবা বন্যার সময় বাড়তি জলপ্রবাহ ধারণ করতে না পাড়লে নদীকে গতি পরিবর্তন করতে হয়। এ দেশে প্রায় ১৪ হাজার ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ আঁকাবাঁকা অথবা চুলের বেণীর মতো প্যাঁচানো। পলি অথবা জলপ্রবাহ অনেক বেশি হলে সৃষ্টি হয় ভাঙ্গন। এছাড়া যে নদীর পাড় খুব একটা স্থিতিশীল নয় সেখানেও ভাঙ্গনের প্রবণতা বেশি। একদিকে পাড় ভেঙ্গে দেয়, আরেকদিকে প্রবাহ বাধা পেলেই গতিপথ পরিবর্তন করে। নদী শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এভাবেই অনেক নদী হারিয়ে গেছে। ভাঙ্গনের মতো নদীতে চর জাগার বিষয়টিও নদীর চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক নদী ভরাট হয়ে মরাগাঙে পরিণত হচ্ছে। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অবরুদ্ধ হচ্ছে। নদী পরিণত হচ্ছে খালে। শুকনা মৌসুমে সেচের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নাব্য হ্রাস পেয়ে বিঘিœত হচ্ছে নৌ চলাচল। পানিপ্রবাহ কমেছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা ও তিস্তায়। এর প্রভাবে অনেক ছোট নদী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। খলসডোঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেঁতুলিয়া, ইছামতি, নারদ, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কাকেশ্বরী, চিকনি, চিকনাই, করতোয়া, রূপনাই, ফুলেশ্বরী, বাঙালী, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা, গোমতী, গুঙ্গানী, ট্যাপাখাওয়া, উছলি ইত্যাদি নামের নদীগুলো কোথাও মরাগাঙ আবার কোথাও শুকনা। অনেক নদী শুকিয়ে আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। দখলও হয়েছে নদীভূমি। যেমন বগুড়া নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী বর্ষায় সামান্য ভরে ওঠে। বড়জোর এক মাস থেকে যে অবস্থা সেই। শুকিয়ে গিয়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়। নগরীর ভেতরেই নদীকে চেনা যায় না। এ নদীর দুই তীরের অনেকটাই দখল হয়েছে। এ নদী কত বড় ছিল তা ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড ও ১৯৬২ সালের এমআর রেকর্ডে উল্লেখ আছে। নদী রক্ষায় এ রেকর্ডও দেখা হয় না। খরস্রোতা এ নদীর নাব্য হ্রাস হয় গত শতকের ’৮৭-৮৮ সালে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির কাছে বহমান করতোয়ার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে ওই পানি বাঙালী নদীতে ঘুরিয়ে দেয়ায় জন্য চকরহিমপুরে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। এর প্রবাহে করতোয়া দিনে দিনে হয়ে ওঠে খাল। পানি না থাকায় গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত নদীর নানা স্থান শুকিয়ে যাওয়ায় শুরু হয় দখল প্রক্রিয়া। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তার পানিপ্রবাহ নিম্নগামী। শাখা নদীতে পানিপ্রবাহ কমছে। নাব্য হারিয়ে মরে যাচ্ছে। বর্ষায় উজানের ঢলে পানিপ্রবাহ বাড়ে। হেমন্তের শুরুতেই কোথাও পানি থাকে না। বড়াল নদী বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে। পানির মাত্রা ৪৫ থেকে ৮০ ফুট। শুকনায় ৩০ থকে ১০ ফুট। বহু স্থানে তাও থাকে না। মহানন্দা (উপনদী) বর্ষায় ৭২ দশমিক ১২ ফুট। শুকনা মৌসুমে ২৫ ফুট। করতোয়া শাহজাদপুরে বর্ষায় ৬০ ফুট, শুকনায় ৫ দশমিক ৪ ফুট। চাটমোহরে গোমনী নদী বর্ষায় পানিপ্রবাহ সেকেন্ডে ১৮ হাজার ২শ’ ৫০ কিউসেক, শুকনায় মাত্র ২শ’ কিউসেক। বাঘাবাড়ি ঘাটে বর্ষায় হুরাসাগরের পানির উচ্চতা ৬৫ দশকি ৮৮ ফুট, শুকনায় ১৩ দশমিক ৭ ফুট। চিকনি বর্ষায় ২৫ ফুট, শুকনায় ৪ দশমিক ৫ ফুট। নারদ বর্ষায় ২২ ফুট, শুকনায় পানি থাকে না। নদীভাঙ্গন, নদীতে চর জেগে ওঠা, হারিয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারে সরকার বারবার সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। বাস্তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তারও উদ্যোগ নেই।
×