ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লেবাননে দেড় লাখ কর্মী নিয়োগ দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে থেমে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২ জুলাই ২০১৭

লেবাননে দেড় লাখ কর্মী নিয়োগ দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে থেমে গেছে

ফিরোজ মান্না ॥ লেবানন বাংলাদেশ থেকে দেড় লাখ কর্মী নেয়ার জন্য গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এমওইউ স্বাক্ষর করে। এ বছরের শুরুতে কর্মী নিয়োগের চূড়ান্ত চুক্তি সই করার কথা ছিল। কিন্তু দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে বাজারটিতে আপাতত নতুন করে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না। দুই দেশের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরের পর দালাল চক্র দেশটির বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসা সংগ্রহের চেষ্টায় তদবির শুরু করে। বিষয়টি লেবানন কর্তৃপক্ষ জানার পর বাংলাদেশের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি স্থগিত করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশটিতে অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন কি যারা এক মালিকের অধীন থেকে অন্য মালিকের কোম্পানিতে কাজ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, লেবানন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী, ফার্নিচার ও কৃষি কাজে দেড় লাখ কর্মী নেয়ার জন্য গত বছরের অক্টোবরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি এমওইউ (সমঝোতা) স্বাক্ষর করে। দেশটির কর্তৃপক্ষ প্রথম দফায় ৫০ হাজার কর্মী নিয়োগ করার কথা জানায়। পরে পর্যায়ক্রমে বাকি কর্মীদের ২০১৭ সালের মধ্যে নিয়োগ করবে। এমন একটি খবর পেয়ে বাংলাদেশী দালাল চক্র (যারা দীর্ঘ দিন ধরে দেশটিতে বসবাস করে আসছে) বিভিন্ন কোম্পানিতে ভিসা সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। দালালরা কোম্পানিগুলোতে কে কত কম বেতনে লোক দিতে পারবে এমন প্রতিযোগিতা শুরু করে। কোম্পানিগুলোও দালালদের প্রলোভনে রাজি হয়ে যায়। কোম্পানিগুলো থেকে দালালদের জানানো হয় বাজার খুললে তাদের কর্মী নিয়োগের জন্য বলবে। এ অবস্থায় বিষয়টি লেবানন কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে তারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানায়। একই সঙ্গে কর্মী নিয়োগের চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়টি স্থাগিত রাখার কথা জানিয়ে দেয়। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, লেবাননে কর্মরত বেশির ভাগ প্রবাসী নারী গৃহকর্মী। এছাড়া কেউ কেউ সুপারমার্কেট, ফার্নিচারের দোকান, হাসপাতাল অথবা অফিসে কাজ করে। আর কিছু কর্মী কৃষি ও নির্মাণ শিল্পে কাজ করে আসছেন। লেবাননে বাংলাদেশীদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা দালালদের কথায় অথবা স্বেচ্ছায় কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। এ কারণে দেশটির সরকার কঠোর আইন করেছে। যারা এক মালিক থেকে পালিয়ে অন্য মালিকের অধীনে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া বিদেশী একজন কর্মীকে চাকরি দেয়ার সময় একজন লেবাননিজ মালিককে গড়ে প্রায় দুই হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়। এর মধ্যে ফি হিসেবে সরকারকে দিতে হয় ৮শ’ ডলার। চাকরিতে যোগ দেয়ার এক সপ্তাহ বা এক মাস পর কর্মী পালিয়ে গেলে কোন মালিকেরই খুশি হওয়ার কথা নয়। এমনও ঘটনা আছে চাকরি পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মাথায় অন্য কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সূত্র জানিয়েছে, গত বছর লেবাননের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের সময় লেবানন কর্তৃপক্ষ কর্মী নিয়োগের বেলায় অভিবাসন ব্যয় কমানোর প্রস্তাব দেয়। লেবাননের প্রস্তাবের সঙ্গে মন্ত্রণালয় একমত পোষণ করে। অভিবাসন ব্যয় কমাতেই হবে। বেশি ব্যয়ে কর্মী নিয়োগ হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের খরচ তুলতে পারেন না। পরে তারা অবৈধভাবে কাজ করেন। এটা যাতে না হয়, তার জন্য সবার আগে অভিবাসন ব্যয়ের দিকেই নজর দিতে হবে। বেসরকারী পর্যায়ে লেবাননে কর্মী নিয়োগ হবে। তবে নিয়োগের বিষয়ে মন্ত্রণালয় কঠোর নজর রাখবে। কোন জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান যাতে বেশি টাকা নিতে না পারে সেজন্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া মনিটর করবে। কথা ছিল এবছরের শুরুতে লেবানন কর্তৃপক্ষ ঢাকা সফরে এসে চূড়ান্ত চুক্তি সই করবে। তখনই সিদ্ধান্ত ছিল উভয় পক্ষ বসে লেবাননে কর্মী নিয়োগের খরচ নির্ধারণ করা করবে। চুক্তিতে খরচের বিয়ষটি উল্লেখ থাকবে। অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছিল। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠাবে। তাদের সরকার নির্ধারিত খরচের মধ্যেই কর্মী পাঠাতে হবে। বাড়তি টাকা রিক্রুটিং এজেন্টরা নিতে পারবে না। কেউ বেশি টাকা নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এত কিছুর পর হঠাৎ করে বাজারটি এমন অবস্থায় পড়বে তা মন্ত্রণালয় বিশ্বাসই করতে পারছে না। লেবাননে দালালদের দৌরাত্ম্য বদ্ধের জন্য বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতে কোন কিছু হচ্ছে না। লেবানন কর্তৃপক্ষ এর আগে জানিয়েছিল-বাংলাদেশী কর্মীরা সেখানে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। লেবানের মানুষ বাংলাদেশী কর্মীদের বেশ পছন্দ করে। কারণ বাংলাদেশীরা কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি আন্তরিক। বাংলাদেশী নারী ও পুরুষ কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, সব খাত (বিশেষ করে নির্মাণ, চিকিৎসা, নার্স ও প্রকৌশলী) বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করার বিষয়ে লেবানন রাজি ছিল। বেশ কিছু বিষয়ে দুই দেশ একমতও পোষণ করেছে। লেবাননে কর্মরত বাংলাদেশী কর্মীদের ক্ষেত্রে সে দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ। আর নতুন বেতন উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সইয়ের পর কার্যকর হবে। কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে লেবাননে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ, গৃহকর্মী এবং পরিচ্ছন্নকর্মী ছাড়াও অন্যান্য সেক্টরে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব লেবানন সরকার সক্রিয় বিবেচনা করবে। গত বছরের ১২ আগস্ট দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নুহাদ মাশনুকের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে বৈঠক হয়। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লেবাননে অনিয়মিতভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশী কর্মীদের বিনা জরিমানায় দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। অনিয়মিত কর্মীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে নিয়মিতকরণ করারও আহ্বান জানানো হয়। তাদের ভিসাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন, আটককৃত বাংলাদেশীদের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রদানের বিষয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী। লেবাননের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের বিষয়ে সে দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এছাড়া তিনি বিনা ভিসায় অবস্থানকারী মহিলা কর্মীদের জরিমানা পরিশোধ ব্যতীত দেশে প্রত্যাবর্তনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
×