ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে থেমে নেই দুদক

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৭ জুন ২০১৭

সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে থেমে নেই দুদক

আরাফাত মুন্না ॥ আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট থেকে বাধা এলেও থেমে নেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত আগের মতোই চলবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র। কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নিতে সেখানে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট) প্রেরণ করা হয়েছে। এদিকে কোন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অন্য কোন অভিযোগ উত্থাপিত হলে, সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ ছাড়া তার প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধান না করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করেছে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। একই সঙ্গে এই নির্দেশনা লংঘন করে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত বা অনুসন্ধান পরিচালনা করা হলে তা সুপ্রীমকোর্টকে অবহিত করতেও বলা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আইন ও বিচার বিভাগকে পরামর্শ দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি পত্র দিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। ওই পত্রে বলা হয়েছে, কোন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ব্যতিরেকে কোন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের গোচরীভূত হয়েছে যে, কোন কোন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অন্য কোন অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই আইন ও বিচার বিভাগের নির্দেশে প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের প্রাথমিক তদন্ত বা যে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা অনভিপ্রেত, অনাকাক্সিক্ষত, অগ্রহণযোগ্য এবং তা কোনভাবেই কাম্য নয়। পক্ষান্তরে এটা সংবিধানের ১০৯, ১১৬ ও ১১৬(ক) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লংঘন বলে জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়েছে। সাবেক বিচারপতির দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের সুপ্রীমকোর্টের দেয়া চিঠি নির্দেশনা মানতে দুদক আইনত বাধ্য নয় বলে জানিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক। তিনি বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান। যে কোন অভিযোগের বিষয়েই দুদক তদন্ত করতে পারবে, দুদক আইনে তাই বলা আছে। আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামও বলেছেন, আইনের চোখে সবাই সমান। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে গত ২ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এর জবাবে গত ২৮ এপ্রিল আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না বলে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আইনের উর্ধে কেউ নেই, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুসারে পুলিশ যে কোন বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। তেমনি দুদক আইন অনুযায়ী যে কোন অভিযোগের বিষয়ে দুদক যে কারও বিরুদ্ধেই তদন্ত করতে পারবে। এই তদন্তে বাধা দেয়ার ক্ষমতা আইন কাউকেই দেয়নি। সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদকের চলমান তদন্ত বন্ধের সুপ্রীমকোর্টের চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা যাবে না, এমন কোন আইন আছে বলে আমার জানা নেই। আইনের কাছে সবাই সমান। কোন তদন্তের ওপরই প্রভাব বিস্তার করা যায় না। সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠিকে ‘ফেইলর অব দ্য রুল অব ল’ বলেই মনে করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। এই চিঠির নির্দেশনা দুদক মানতে বাধ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, সুপ্রীমকোর্ট থেকে পাঠানো চিঠির বিষয়ে আমাদের কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। একজন সাবেক বিচারপতির তদন্ত বন্ধে সুপ্রীমকোর্টের চিঠিতে দুর্নীতি দমন কমিশন বিব্রত কি-না, জনকণ্ঠের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক বিব্রত নয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অন্যদিকে আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে দুদককে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে সুপ্রীমকোর্ট থেকে চিঠি দেয়া হলেও অবসরে যাওয়া একজন জেলা জজের বিরুদ্ধে অভিযোগের নথিপত্র দুদকের প্রেরণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে। জানা গেছে, কুষ্টিয়ার সাবেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ আফজাল হোসেনের (জেলা জজ) বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নথিজাতকরণের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের পরামর্শ চাইলে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ও প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনসহ সকল নথিপত্র দুদকে প্রেরণের পরামর্শ দেয় হাইকোর্ট বিভাগ। গত বছরের ১৫ নবেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সহকারী রেজিস্ট্রার (বিচার) সোহাগ রঞ্জন পাল স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই পরামর্শের কথা জানানো হয়। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩ থেকে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়। এর জবাবে গত ৪ এপ্রিল সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার (বিচার) মো’তাছিম বিল্যাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পুনর্বিবেচনার আবেদন নামঞ্জুর করে পূর্বে পাঠানো পরামর্শ বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণে আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া হয়। এদিকে আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেয়া রায় সকলের উপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, একজন বিচারপতি অনেক রায় দিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত বন্ধে এটা কোন কারণ হতে পারে না। তিনি বলেন, ওই বিচারক যেসব মামলার রায় দিয়েছেন, যদি এতে কোন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাহলে তার দুর্নীতির অভিযোগে বিচার চলার পাশাপশি ফৌজদারি আইনেও মামলা চলতে বাধা নেই। তিনি আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্টের চিঠিতে বলা হয়েছে তার রায়ে অনেকের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। যদি ওইসব মৃত্যুদ-ের রায়ে তিনি কোন দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন তাহলে তো তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা উচিত। কোন আইনেই তদন্ত বন্ধের নির্দেশ দিতে কাউকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মোঃ জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি। আলোচিত এই বিচারপতি ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। দুদকের দেয়া নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করেছিলেন। রিটের ওপর শুনানি গ্রহণের পর বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। ওই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশিত আলম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিট খারিজের ফলে এখন দুদকের দেয়া নোটিসের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে আর কোন আইনগত বাধা নেই। সম্পদ বিবরণী চেয়ে গত ১৮ জুলাই দুদক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে নোটিস দিয়েছিল বলে তিনি জানান। রিট দায়েরকারীর আইনজীবী আহসানুল করিম ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে দুদক সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস দেয়। ওই নোটিস দেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ হয়েছে বলে আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে। আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের জন্য মানা বাধ্যকর। এ যুক্তিতে আদালত রিটটি উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন।
×