ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি

নওয়াব বাড়ি নিয়ে ফের জটিলতা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৬ জুন ২০১৭

নওয়াব বাড়ি নিয়ে ফের জটিলতা

সমুদ্র হক ॥ ইট সিমেন্টের বিশাল ফটক। রং চটে গেছে। কোথাও খসে পড়েছে পলেস্তারা। ওপরের দিকে দৃষ্টি দিলে দুটি সাইনবোর্ড। একটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নীল রঙের। যেখানে সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার কথা বলা আছে। আরেকটি ব্যক্তি মালিকানার। বলা আছে ক্রয় সূত্রে এই স্থাপনার মালিক তিন ব্যক্তি। সাইনবোর্ডের বাইরে যে কথা তা হলো : এই সম্পত্তি ওয়াকফ এস্টেটের। তাহলে বগুড়ার শত বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যের এই নওয়াব প্যালেসটি (অধিক পরিচিতি নওয়াব বা নবাব বাড়ি) আসলে কার! দিনে দিনে বিষয়টি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণের মনে। বগুড়ার নবাব বাড়ি নিয়ে সাধারণের কৌতুহলও কম নয়। নগরীর কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে একশ’ মিটার পূর্ব দিকে এই প্রাচীন বাড়ির অবস্থান। প্রবীণরা বলেন এই বাড়ির নওয়াব ছিলেন জমিদার। বগুড়ার নয় আনা অংশের জমিদারও বলা হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ-ভারতের নাইট উপাধি পেয়েছিলেন জমিদার নবাব বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই জমিদার বাড়িতেই জন্মেছিলেন তৎকালিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া। নওয়াব বাড়ি এবং জমিদারের বেশিরভাগ সম্পত্তি ওয়াকফ এস্টেটের আওতায়। ওয়াকফ সম্পত্তির তৎকালিন মোতোয়ালি মোহাম্মদ আলী বগুড়ার বৈমাত্রেয় ভাই ওমর আলী চৌধুরী (প্রয়াত) ৮০র দশকে প্রাচীন আদল পাল্টে সংস্কার করে আধুনিক স্থাপনা গড়ে তোলেন। বগুড়ার খ্যাতিমান শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল (প্রয়াত) প্যালেসের ভিতরে জমিদার আমলের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বংশ পরম্পরায় জমিদার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের লাইভ সাইজ প্রতিকৃতি ও মনুমেন্ট এমনভাবে নান্দনিকতার সঙ্গে স্থাপন করেন, যা দেখে মনে হয় সেদিনের জমিদার বাড়ির লোকজন এখন স্থির হয়ে আছে। বাড়ির বাইরে বাঙালীর ঐতিহ্যের নানা কিছু প্রদর্শন করা হয়। বাড়ির বহির্আঙ্গিনায় বিরল দুইটি বৃক্ষ জয়তুন ও কর্পূর ঐতিহ্যকে বাড়িয়ে দেয়। বগুড়ার মানুষ ও মিডিয়া নওয়াব বাড়ি রক্ষায় মাঠে নামে। তারপর সরকার নওয়াব বাড়িকে ঐতিহাসিক প্রতœতাত্ত্বিক স্থাপনা বিবেচনায় আনে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর নওয়াব বাড়িকে সংরক্ষিত পুরাকীতি এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। যা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ১২ মে ২০১৬ তারিখের গেজেটে অন্তর্ভুক্ত (গেজেট নোটিফিকেশন) হয়। গেজেটে লিখা আছে: “১৯৬৮ সালের ১৪ নম্বর আইন ১৯৭৬ সালে সংশোধিত পুরাকীর্তি আইনের ১০ নম্বর ধারার ১ উপধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সরকার কর্তৃক তপসিলভুক্ত প্রতœ সম্পদ ‘সংরক্ষিত প্রতœসম্পদ’ বলিয়া ঘোষনা করা হইলো।” সরকারের এই ঘোষনাকে সাধুবাদ জানিয়ে বগুড়ার মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। হঠাৎ করেই আনন্দ মিলিয়ে যায়। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সাইন বোর্ড টাঙ্গানো পর্যন্ত সরব থাকে। এরপর তারা নিরব হয়ে যায়। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সূত্র জানায়, এই স্থাপনার ক্রেতারা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। রিট মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ওই স্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এরই মধ্যে এ বছর ৯ এপ্রিল অতি গোপনে রাতের অন্ধকারে নওয়াব বাড়ির ভিতরে বিরল প্রজাতির জয়তুন বৃক্ষটি কেটে ফেলা হয়। যেখানে স্থাপনার কোন কিছুতেই হাত দেয়া পর্যন্ত নিষেধ সেখানে কি ভাবে বিশাল একটি বৃক্ষ কেটে ফেলা হলো এ নিয়েও সুধীজনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ক্রয় সূত্রে মালিকানা দাবিদারদের নিয়োজিত এক ব্যক্তি বলেন, ঝড়ে বৃক্ষটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল তাই কেটে ফেলা হয়েছে। বৃক্ষ কাটার আগে বন বিভাগ ও সরকারের কোন দফতরের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি। বগুড়ার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ওই সময় বলেছিলেন বগুড়ায় এই বিরল জয়তুন বৃক্ষের কথা তিনি জানেনই না (বুঝে নিন কেমন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা)।
×