ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি নেতা হারুন চৌধুরীর পলায়নে উদ্বেগ, আতঙ্ক

সাত মাসেও নিখোঁজ কিশোরীর সন্ধান মেলেনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ জুন ২০১৭

সাত মাসেও নিখোঁজ কিশোরীর সন্ধান মেলেনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সাত মাসেও বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হারুন চৌধুরীর বাসা থেকে নিখোঁজ কিশোরীর সন্ধান মেলেনি। একদিকে মেয়ে, আরেকদিকে ঝড়ে বাড়িঘর ভেঙ্গে যাওয়ার শোকে একেবারে দিশেহারা নিখোঁজ কিশোরীর পরিবার। কিশোরীর পিতার দায়ের করা মানবপাচার মামলার অন্যতম প্রধান আসামি হারুন চৌধুরীকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতারের পর সিআইডি পুলিশ আদালতে হাজির না করেই ছেড়ে দিয়েছে। সর্বশেষ গত ১ জুন আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে চার আসামির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আদালত থেকে হারুন চৌধুরীর পালিয়ে যাওয়া এবং তিন আসামির জামিন পাওয়ার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে নিখোঁজ কিশোরীর পরিবারে। নিখোঁজ কিশোরীকে উদ্ধারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তার মামা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হারুন চৌধুরী গ্রেফতার হননি। তিন আসামির জামিন লাভ এবং হারুন চৌধুরী গ্রেফতার না হওয়ায় নিখোঁজ কিশোরীর উদ্ধারের সম্ভবনার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তার পরিবার। মামলার বিবরণী থেকে জানা গেছে, গত বছরের শুরুরদিকে চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীকে আম্বিয়া খাতুন নামের এক নারীর মাধ্যমে কিশোরীর পিতা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার হারুন চৌধুরীর বাসায় মাসিক দুই হাজার টাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে দেন। গত বছর ২২ অক্টোবর মেয়েকে বাড়ি পাঠানোর জন্য হারুন চৌধুরী ও তার স্ত্রীকে অনুরোধ করেন কিশোরীর পিতা। এ সময় হারুন চৌধুরীর মেয়ের জামাই লিটন কিশোরীকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি দেয়া যাবে না বলে মোবাইল ফোনে জানায়। কিশোরীর পিতা নিরুপায় হয়ে ভোলা জেলার চরফ্যাশনের গ্রামের বাড়ি থেকে ওয়ার্ড কমিশনারের ঢাকার হাজারীবাগের বাড়িতে যান। এ সময় আসামিরা তাকে আটকে রেখে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। নিখোঁজ কিশোরীর মামা মোঃ ফিরোজ জানান, নিখোঁজ কিশোরীর পরিবার অত্যন্ত নিরীহ। বোনজামাই পেশায় মূলত দিনমজুর। তবে মাঝেমধ্যে রিক্সা চালিয়ে সংসারের খরচ চালান। অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই খারাপ। বড় সংসার। অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হয়নি। নিরুপায় হয়ে বড় মেয়েকে মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে হারুন চৌধুরীর বাসায় কাজে পাঠান। মেয়েকে বাড়ি পাঠানোর জন্য মোবাইল ফোনে হারুন চৌধুরীর পরিবারকে অনুরোধ করেন। হারুন চৌধুরীর পরিবার ছুটি দেয়া যাবে না বলে জানায়। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এসে মেয়েকে নিয়ে যেতে বলে। সেই বিশ্বাসে আমার ভগ্নিপতি তার বাড়িতে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পর একটি কক্ষে আটকে রেখে আসামিরা বোনজামাইয়ের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। এর পর গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বিষয়টি জানার পর বোনজামাইকে নিয়ে তারা হাজারীবাগ থানায় মামলা করতে যান। মামলা না নিলে জিডি নেয়ার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেন তারা। শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশ মামলা না নিলে বাধ্য হয়ে তারা আদালতের শরণাপন্ন হন। ভগ্নিপতি বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। যদিও হাজারীবাগ থানার ওসি মীর আলিমুজ্জামান দাবি করেছেন, প্রথমদিকে কিশোরীর পরিবার যোগাযোগ করলেও পরে তারা আর যোগযোগ করেননি। পরবর্তীতে কিশোরীর পিতা আদালতে মামলা দায়ের করেন। নিখোঁজ কিশোরীর মামা জানান, এ মামলার চার আসামি গত ১ জুন ঢাকা মহানগর আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যান। ওই সময় আদালতে চার আসামিই হাজির ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিন আসামি জামিন নেন। অন্যতম প্রধান আসামি হারুন চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত আর আদালতে দেখা যায়নি। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান। তিন আসামির জামিন লাভ আর হারুন চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর সিআইডি পুলিশ কর্তৃক ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত তারা। তার অভিযোগ, সিআইডি পুলিশ সুবিধা পেয়ে হারুন চৌধুরীকে আদালতে সোপর্দ না করেই ছেড়ে দিতে পারে। আসামিরা খুবই প্রভাবশালী। যেকোন সময় আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। তিনি নিখোঁজ ভাগ্নিকে উদ্ধারের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। নিখোঁজ ভাগ্নিকে পেলেই তারা সন্তুষ্ট। যদিও সিআইডি পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন নাহার দাবি করেছেন, আসামি হারুন চৌধুরী গ্রেফতারের পর পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এজন্য আইন মোতাবেক আসামিকে আদালতে হাজির না করেই মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় দলিলাদি তাদের হাতে রয়েছে। পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার আনিসুর রহমান জানান, মানব পাচারের ওই মামলায় তিন আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করে গত ১ জুন জামিন লাভ করেছেন। অপর আসামি অজ্ঞাত কারণে আত্মসমর্পণের জন্য আদালতে আসার পর আত্মসমর্পণ করেননি। পরে তাকে আর আদালতেও পাওয়া যায়নি। কোর্ট পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আসামি হারুন চৌধুরী আদালতে এসেছিলেন। তিনি আদালতে তার আইনজীবীসহ আদালতসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই দেখাসাক্ষাত করেন। কয়েক দফায় বৈঠকও করেন। ধারণা করা হচ্ছে, বৈঠকে আদালতসংশ্লিষ্টরা হারুন চৌধুরীর জামিন হবে না বলে জানান। এমন কথাবার্তার পরেই হারুন চৌধুরী আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমদিকে আদালতে তার আত্মসমর্পণের কথা ছিল। সে মোতাবেক তালিকাও দিয়েছিলেন তার পক্ষের আইনজীবী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হারুন চৌধুরী আর আত্মসমর্পণ করেননি। পরবর্তীতে হারুন চৌধুরীকে আর আদালত চত্বরে দেখা যায়নি। রহস্যজনকভাবে তিনি সটকে পড়েন। অপর তিন আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, মানবপাচারের ওই মামলায় চার আসামি ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হাজির হন। ঢাকা মহানগর হাকিম আব্দুল্লাহ আল মাবুদ বেলা এগারোটার দিকে ওই আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করে পরে আদেশ দেবেন বলে জানান। দুপুরে আদালতের নথিতে দেখা যায়, হারুন চৌধুরী ছাড়া অপর তিন আসামি জামিন পেয়েছেন। জামিন আবেদনপত্র থেকে হারুন চৌধুরীর নাম কেটে দেয়া হয়েছে। হারুন চৌধুরীর জামিন মঞ্জুর অথবা নামঞ্জুরের বিষয়ে আদালতের কোন আদেশ নেই। মামলার রেকর্ড অনুযায়ী গত বছর ২৭ অক্টোবর আদালতে নালিশি মামলা দায়ের করেন নিখোঁজ কিশোরীর পিতা। আদালতের নির্দেশে আসামি আম্বিয়া খাতুন, হারুন চৌধুরী, তার স্ত্রী ও মেয়ের স্বামী লিটনের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা রেকর্ড করে হাজারীবাগ থানা পুলিশ। মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক মোঃ খুরশীদ আলম গত ৯ মে হারুন চৌধুরীকে গ্রেফতার করেন। গত ১১ মে লিখিতভাবে আদালতকে বিষয়টি জানালেও কাকে গ্রেফতার করেছেন, ওই আসামি কোথায় রয়েছে তা আদালতকে অবহিত করেননি। গত ২২ মে ঢাকার মহানগর হাকিম জিয়ারুল ইসলাম দুই কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হয়ে আসামি কোথায় এবং কেন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়নি তার জবাব দিতে আদেশ দেন। গত ২৪ মে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে হাজির হয়ে আসামি হারুন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে জানান। গ্রেফতারের পর পরই আসামি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সিআইডির উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হারুন চৌধুরীকে মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানান। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু জানান, আসামিকে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির না করে ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি পুলিশের। এমন ঘটনায় পরবর্তীতে আদালত এ সংক্রান্ত একটি আদেশ দেয়। আদেশে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তনের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক তদন্তকারী কর্মকর্তার বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে বার বার যোগাযোগ করা হলেও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন নাহারের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যদিও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রেজাউল হায়দার জানান, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা তিনি জানাননি। বাদী পক্ষের আইনজীবী এসএম জাহিদ হাসান জানান, নিখোঁজ কিশোরীর পিতা পয়সার অভাবে ঢাকায় আসতে পারছেন না। তারমধ্যে ঝড়ে ঘর ভেঙ্গে পড়ায় আরও বিপাকে পড়েছেন। নিখোঁজ কিশোরীর পরিবার মেয়ের সন্ধান পেলেই সন্তুষ্ট। নিখোঁজ কিশোরী গুম, খুন না কি পাচারের শিকার হয়েছে তা সোমবার নাগাদ জানা যায়নি।
×