ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর দুই বইয়ে উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩১ মে ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর দুই বইয়ে উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বঙ্গবন্ধুর বই দুটিতে শুধু তার ব্যক্তি জীবনই উঠে আসেনি, উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। কারাগারের রোজনামচা বইটিতে খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতিপ্রেমী বঙ্গবন্ধুকে। লক্ষ্য অর্জনে আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু কতটা মানবতাবাদী ছিলেন তাও উঠে আসে গ্রন্থটিতে। বইটিতে তিনি এক পকেটমারের জীবন কাহিনী লিখেছেন ৮ পাতাজুড়ে। জীবনের কোন কিছুই তিনি লুকাননি। বলেছেন অকপটে। নিজের পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে লিখেছেনÑ আমি তো লুঙ্গিই পরি। পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির হৃদয়ে ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানা। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতেন। আর তুলে ধরতেন সেই বৈষম্য। মানুষকে ভালবেসেই তিনি শীর্ষ রাজনৈতিক হয়ে উঠেন। আর স্বাধীনতা উপহার বাঙালী হৃদয়ে দখল করে নেন পিতার আসন। মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে কারাগারের রোজনামচা : দ্য আনফোল্ডিং অব বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধ আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। প্রবন্ধটি রচনা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ। এশিয়াটিক সোসাইটির ১৫তম মাসিক সাধারণ সভা উপলক্ষে গ্রন্থটির ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মোট ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে ড. হারুন গ্রন্থটির খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। তার আলোচনায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে রাজনৈতিক জীবনের পুরো ঘটনা। আলোচনায় এশিয়াটিক সোসাইটির সহসভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানমের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী। মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। মূল প্রবন্ধ পাঠকালে প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, চেতনা ও বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু সব সময় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। নৈতিক শক্তিতে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন। তার মাঝে অসাধারণ রসবোধ ছিল। তার গ্রন্থ পাঠের পর আমার মনে হয়, তিনি উচ্চমানের কথাসাহিত্যিক। কারণ, লেখক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করা যায় একজন রসিক সাহিত্যিক হিসেবে। তার লেখায় বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, ঘটনার সহজ-সরল রসাত্মক বর্ণনা, উপমা ও উদাহরণ। শব্দশৈলী ও এর গতিময়তা সবাইকে আকৃষ্ট করে রাখে। এসব কারণে বঙ্গবন্ধুর লেখা বই পাঠে থাকে চুম্বক আকর্ষণ, যা শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। তিনি বলেন, কারাগারে রচিত বঙ্গবন্ধুর দুটি গ্রন্থই শুধু তার কারাজীবনের ঘটনাবলি নিয়ে নয়, বরং পাকিস্তানী শাসন-নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব বাংলার মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, শোষণ-নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। সেলের পাশে সবুজ ঘাস জমিয়ে লন করেছেন নিজ হাতে। আপন হাতে আগাছা উপড়ে ফেলেছেন। রাতের আঁধারে আকাশ দেখেছেন। লক্ষ্য অর্জনে তিনি ছিলেন প্রচ- আত্মপ্রত্যয়ী। কোনদিনই জন্মদিনের উৎসব করেননি। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতেন। তাদের জীবনের খুঁটিনাটি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কারাগারের রোজনামচায় একজন পকেটমারের জীবন কাহিনী লিখেছেন ৮ পাতাজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর নিজের কোন কিছুই লুকাননি। বলেছেন অকপটে। সবকিছুতেই তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন বলেন, ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ও কুর্মিটোলার কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু এই দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমি ৫ মাস নাজিমউদ্দিন রোডের জেলে ছিলাম, কারাগারের রোজনামচা পাঠের পর এখন মনে করি এটি আমার সৌভাগ্য। কারণ, বইটিতে জেলের খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। বইটি পাঠের সময় সে সময়কার ৫ মাসের স্মৃতি আমার কল্পনাতেও ভেসে ওঠে। উভয়গ্রন্থে কারাগারের ভেতরের কথাই নয়, সমস্ত বাংলা যে একটি কারাগার তা উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বড় কারগার থেকে ছোট কারাগারে এসেছি। ’৪৭ থেকে ’৭১ বুঝতে হলে ’৪৭-এর আগের ঘটনা ভাল করে বুঝতে হবে। একইভাবে ’৭১-এর আগের ঘটনাও। ’৪৭ সালে পাকিস্তান যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল না। কলকাতায় বসে তিনি একাধিক বক্তব্যে স্বাধীন বাংলার অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তার রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল ইনডিপেডেন্ট স্টেট। সোহ্রাওয়ার্দীর স্মৃতিও বই দুটিতে রয়েছে। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান নয়, কয়েকটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। অথচ ভাষা বিতর্ক নিয়েই পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। বাঙালী সত্তার সৃষ্টি হাজার বছর ধরে। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির সেই সত্তা ধারণ করেই স্বাধীন বাংলার ঘোষণা দেন। একটি অপ্রস্তুত জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দেন। দীর্ঘ ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন সত্যি তবে ’৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তার রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল না। দেশ বিভাগের আগে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় প্রমুখের নেতৃত্বে গৃহীত স্বাধীন অখ- বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় বলেন, বঙ্গবন্ধু কত বড় সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তা বুঝতে হলে তার রাজনৈতিক জীবন বুঝতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তি তখনই বড় মাপের রাজনৈতিক হয়ে উঠে যখন তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে পারেন। সমাজকে যে রাজনৈতিক ব্যক্তি যত বেশি চিনতে পারেন তিনি তত বেশি জনপ্রিয় হন। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু বাংলার রাজনীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছেন। উনি উনার পুরোধা ব্যক্তিদেরও ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও সমাজকে তিনি খুব ভাল করে জেনেছিলেন। সে কারণে উনার সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয়নি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছিলেন, তিনি আবেগপ্রবণ। আবার তিনি এও বলেছেন, আমি মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ নই। বঙ্গবন্ধু বাঙালী চরিত্রের নিচুতা ও দুর্বলতা জানতেন। বঙ্গবন্ধু তার ভালবাসা দিয়ে বাঙালীকে এক করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি কখনও পালানোর রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন না উল্লেখ করে বিশিষ্ট এই কলামিস্ট আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন না। ইয়াহিয়া যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করান তখন পুরো বিশ্ব বলতে বাধ্য হলো এনজন নির্বাচিত নেতাকে গ্রেফতার করা যায় না। উনি যদি পালিয়ে যুদ্ধে যেতেন তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হতেন।
×