ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

চিকিৎসা ॥ ডাক্তার বনাম রোগীর স্বজন

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৩০ মে ২০১৭

চিকিৎসা ॥ ডাক্তার বনাম রোগীর স্বজন

রুগী শোনে না ডাক্তারের কথা, সন্তান শোনে না পিতামাতার কথা, কর্মী শোনে না রাজনৈতিক নেতার কথা, ছাত্র শোনে না শিক্ষকের কথা, কর্মচারী শোনে না কর্মকর্তার কথা, ঠিকাদার শোনে না ইঞ্জিনিয়ারের কথা। এই যে স্বেচ্ছাচারিতা, এটা মনে হয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। একজন চিকিৎসক হিসেবে এটা কিন্তু বহুদিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গত ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার, সেন্ট্রাল হাসপাতালে যে সহিংস ঘটনাটি ঘটে গেল, সেটার মূলে অন্তর্নিহিত রহস্য কি উদঘাটন হওয়ার আগেই একটা ধ্বংসলীলা ঘটে গেল। সম্পদের ধ্বংস, সেটা হয়ত পূরণ করা যাবে। ব্যক্তিত্বের অপমান মুখ বুজে সহ্য করা গেলেও, চরিত্রের যে ধ্বংস বা কালিমা, এটা কি উদ্ধার করা যাবে? ঐ ঘটনায় বাংলাদেশের একনম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্ররা যে ঘটনাটি ঘটাল, সেটা কখনও সমাজের কাছে আকাক্সিক্ষত নয়। যাদের বিরুদ্ধে ঘটনাটি ঘটল, সেখানে অধ্যাপক মতিউর রহমানের স্যারের মতো একজন বিজ্ঞজন শিক্ষক, সারাদেশে এক নামে পরিচিত চিকিৎসক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ এবং ঐ হাসপাতালের পরিচালনা কর্তৃপক্ষসহ আমার সন্তানতুল্য কিছু সদ্য পাস চিকিৎসকের ওপরে যে অবমাননাকর ন্যক্কারজনক আঘাতগুলো হলো, এটা কোন ক্রমেই আশা করা যায় না। রাস্তার গু-াপা-াদের হাত থেকে, বখাটেদের হাত থেকে, মাদকাসক্তদের হাত থেকে এই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে এই ঘটনা আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। চিকিৎসক সম্বন্ধে ফরাসি লেখক এবং ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক ভলটেয়ারের একটা উক্তি আছে, যে উক্তিটি হলো, ‘গবহ যিড় ধৎব ড়পপঁঢ়রবফ রহ ঃযব ৎবংঃড়ৎধঃরড়হ ড়ভ যবধষঃয ঃড় ড়ঃযবৎ সবহ, নু ঃযব লড়রহঃ বীবৎঃরড়হ ড়ভ ংশরষষ ধহফ যঁসধহরঃু, ধৎব ধনড়াব ধষষ ঃযব মৎবধঃ ড়ভ ঃযব বধৎঃয. ঞযবু বাবহ ঢ়ধৎঃধশব ড়ভ ফরারহরঃু, ংরহপব ঃড় ঢ়ৎবংবৎাব ধহফ ৎবহবি রং ধষসড়ংঃ ধং হড়নষব ধং ঃড় পৎবধঃব.’ তা ছাড়াও পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে ডাক্তারদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হয় না। যদিও এর মধ্যে ডাক্তারদের সম্মান আমার চোখে সবচেয়ে বেশি ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে, পশ্চিম জার্মানিতে, যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নেই। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ডাক্তারদের অবস্থান ছিল ঈশ্বরের নিচে, যীশুর ওপরে। কোন রোগী হাসপাতাল থেকে ভাল হয়ে যাবার পথে চিকিৎসক বা টিমকেই শুধু ধন্যবাদ দিতেন না, যাবার সময় ঐ সমাজের রীতি অনুযায়ী তিনটা ফুল এবং আনুষঙ্গিক কিছু উপহার অবশ্যই দিয়ে বিদায় নিতেন। একজন বিদেশী হিসেবে, একজন সহকারী চিকিৎসক হিসেবে আমিও কিছু পেতাম। যদি কোন রোগী মারা যেতেন, তাহলে রোগীর আত্মীয়স্বজন শুধু চিকিৎসার জন্য কতবার যে এসে চিকিৎসক দলটিকে ধন্যবাদ দিতেন, তা ভাষায় বলার নয়। তবে বাংলাদেশের ডাক্তারদের ভিতরে রাজনীতি ডাক্তার সমাজের মেরুদ-কে ভেঙ্গে দিয়েছে। অধ্যাপক এম. এ কাশেম স্যারের বি.এম.এ এবং অধ্যাপিকা ফিরোজা বেগমের বিএমএ আর এখন নেই। এখন আছে দলীয় বিএমএ। এজন্য ডাক্তারদের প্রথম বিভাজন যিনি এনেছিলেন উঅই গঠন করে, তাকে ভবিষ্যত প্রজন্ম ক্ষমা করবে কিনা জানি না। ১৯৭০ সালের পরে চিকিৎসা বিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমি যা দেখেছি, যখন ডাক্তাররা পেশাজীবী ছিলেন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে আচ্ছন্ন ছিলেন না, তখন তাদের ন্যায্য দাবির কাছে সরকারই মাথা নত করতে বাধ্য হতো। এই কিছুদিন আগে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ডাক্তারদের ধর্মঘটের কাছে সরকার এবং জনগণ পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাই বলে কথায় কথায় ডাক্তাররা ঘর্মঘট করবেন, সে কথা আমি বলছি না। তবে এই মুহূর্তে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে, উপ-শহরে যেভাবে ডাক্তারদের লাঞ্ছনা করা হচ্ছে, সেটা কিন্তু কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। ডাক্তারদের পিঠ এখন দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এখন অবশ্যই ডাক্তারদের পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও রোগীর আত্মীয় স্বজন, বন্ধু লেবাসধারী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ডাক্তাররা যদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সব রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভাল করতে পারতেন, তাহলে হয়ত মানুষ চিকিৎসকদের ফেরেশতা বা দেবতাদের ওপরে এবং স্রষ্টার নিচেই স্থান দিতেন, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সম্মান আমরা আশা করি না। কারণ মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্য চারটির মতো চিকিৎসা ছিল সরকারের দায়িত্ব এবং চিকিৎসকরা ছিলেন নন প্র্যাকটিসিং। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা যেটুকু চাই সেটা হলো, আমাদের একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে দিতে হবে। আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে বর্তমান নবীন চিকিৎসকরা কিন্তু আমাদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। আমরা যে রকম ডাক্তারি পাস করার পরেই ওহ-ংবৎারপব ঞৎধরহবব নামে একটি সরকারী চাকরিতে যোগদান করি, পঞ্চম গ্রেডের বেতনে। অতঃপর ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরে উপজেলা স্ব্যাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি পেয়ে যাই। তার পরে নিজেরা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ি। আমরা কখনও বেকার ছিলাম না। জনগণ এবং সরকারের ভেবে দেখা উচিত, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ হাজার করে ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। সরকার কোন অবস্থাতেই এত ডাক্তারের চাকরি দিতে পারে না, দেওয়া সম্ভবও নয় এবং দেওয়ার কোন সুযোগও নেই। আমাদের পরিকল্পিত অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় কি পরিমাণ ডাক্তার দরকার নির্ণয় করতে হবে। প্রতি বছর কত জন অবসরে যাবে, কতজনকে নতুন করে চাকরি দেওয়া যাবে, ঠিক সেই পরিমাণ ডাক্তারই তৈরি করা উচিত। পক্ষান্তরে আমরা যা করছি, সেটা হলো প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশী ডাক্তারদের বাজার কিন্তু বহির্বিশ্বের কোথাও নেই। তা ছাড়াও আমাদের এই ডাক্তাররা যে দেশে বসে ইউএসএ কোয়ালিফাইং টেস্ট, অস্ট্রেলিয়ান কোয়ালিফাইং টেস্ট অথবা ব্রিটিশ কোয়ালিফাইং টেস্ট দিয়ে দেশের বাইরে যাবেন, সে সুযোগও কিন্তু বিদ্যমান নেই। সদাশয় সরকারের উচিত সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। এই নতুন পাস করা ডাক্তাররা পেটের দায়ে মা বাবার কাছ থেকে টাকা এনে চলতে পারবেন না বলেই দু’ তিনটা ক্লিনিকে চাকরি করে মানবেতর জীবন যাপন করেন। তাদের কারও বেতনই সরকারী ডাক্তারদের প্রাপ্ত বেতনের অর্ধেকের সমান নয়। সেই ডাক্তারদের আবার বিসিএস দেওয়ার চিন্তা থাকে, পোষ্ট গ্রাজুয়েট পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা থাকে। সব মিলিয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা পৃথিবীর কোন দেশে কল্পনা করা যায় না। বলছিলাম প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহর কথা। আমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহ বার বার নির্বাচিত একজন ডিন অর্থাৎ শিক্ষকদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা রোগীদের মধ্যে যেরকম আছে ঠিক একই রকম। তারপরও ডাঃ আবদুল্লাহ কোন দিন অফিসে যদি বিলম্বে আসতেন, তার জন্য হয়ত আমি উপাচার্য হিসাবে কিছু বলতাম না, কারণ সবাই তাকে পেতে চাইত। এবং রাজধানীর সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল বা জটিল রোগীগুলোই ডাঃ আবদুল্লাহর অধীনে বিভিন্ন হসপিটালে ভর্তি হন। আমরা চেষ্টা করেছি ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহর মেধা এবং চিকিৎসা সবাই যেন পায়। কিন্তু এ কথাও সত্য ডাঃ আবদুল্লাহ যদি কোন দিন সকালে একটু দেরিতে অফিসে আসতেন, আড়াইটায় চলে যেতেন না। হাসপাতালের সব রোগী দেখে বিকাল চারটার পরে হাসপাতাল ত্যাগ করতেন। অর্থাৎ অনেক নিয়মানুবর্তী, সুশৃঙ্খল ডাক্তারদের মধ্যে ডাঃ আবদুল্লাহ একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের যে ছাত্রীটিকে নিয়ে এই দুর্ঘটনাটা ঘটল, সেই ছাত্রীটি যখন সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসল তখন তার রক্ত পরীক্ষার যে ব্লাড পিকচার, যা লিউকেমিয়ার ক্যাটাগরিতে পরে, সেটা পাওয়া গেল। তার জ্বর ছিল, সে ডিহাইড্রেটেড ছিল এবং অলমোস্ট ঝযড়পশ এ ছিল। তাকে চিকিৎসা দেবার আগেই তার যখন শারীরিক অবনতি হচ্ছিল, তখন সেটাকে ডেঙ্গু বা হেমোরিজিক ঝযড়পশ, যে কোন চিকিৎসক মনেও করতে পারেন। তাকে যখন আইসিইউতে নেওয়া গেল আইসিইউতে ইনটিউবেশন করার আগেই সে মারা গেল। অর্থাৎ আইসিইউ কেয়ার বা চিকিৎসার কোনটার শুরু হওয়ার আগেই সে মারা গেল। যেহেতু চিকিৎসাই শুরু হয়নি, তাহলে চিকিৎসকের ভুল কোথায় হলো? এই ক্ষেত্রে কি মেয়েটিক হাসপাতালে আনতে, বা এত দেরি করে আনার জন্য তার পরিবার, তার সহপাঠী বা তার সহকর্মীদের কি কোন দায়বদ্ধতা ছিল না? মেয়েটি এমন অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল, তাঁর রোগের ইতিহাসও সঠিকভাবে রোগী নিজে বা অন্য কেউ দিতে পারছিল না। সব কিছু মিলে একজন চিকিৎসককে দোষারোপ করা হলো। তার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কর্তৃক মামলা করা হলো। সবই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নির্দোষ চিকিৎসক বা প্রফেসর আবদুল্লাহর যে সম্মানহানি হলো, সেটা কি ফিরিয়ে আনা যাবে? দৈবক্রমে হয়ত উনি ঐ মুহূর্তে ঐখানে উপস্থিত ছিলেন না, যদি থাকতেন তাহলে ডাঃ আবদুল্লাহর মাথায়ও যদি এইরকম একটি আঘাত হতো এবং তার অকালমৃত্যু ঘটত, তার দায়ভার কে নিতে পারত! বিস্মিত হলে চলবে না, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সূর্য সন্তানের জন্ম দিয়েছে। অনেকে বিজ্ঞানী হয়েছেন, বিদেশে অধ্যাপক হয়েছেন, দেশে রাজনীতিবিদ হয়েছেন। কিন্তু এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একজন মতিন চৌধুরী নেই, একজন মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী নেই, একজন ফজলুল হালিম চৌধুরী নেই, নেই অধ্যাপক মোহাম্মদ শামছুল হক। একজন সত্যেন বোসের জন্ম দিতে পারেনি, একজন জি সি দেবের জন্ম দিতে পারেনি। তাহলে ফারাকটা কোথায় রয়ে গেল। ঐ রকম শিক্ষক যদি তৈরি না হয়, তাহলে ছাত্র কিন্তু আগের মতো তৈরি হবে না, এটা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি। বর্তমানে যে সব প-িত শিক্ষকগণ বেঁচে আছেন, যাদের মধ্যে দেবতার মতো অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আবুল কাসেম মোঃ ফজলুল হক, তাদের সমমানের শিক্ষকও কিন্তু তৈরি হচ্ছে না। কিংবদন্তি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং অধ্যাপক কবির চৌধুরীর মতো শিক্ষক আমরা খুঁজে বেড়াই। অনেকেই হয়তবা আমার মতো লক্ষ্য করেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু তাঁর শিক্ষকদের স্যার বলেই সবসময় সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ছয় বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছি। তখনও দেখেছি দু’চারটা অপ্রীতিকর ঘটনা, যা বহির্বিভাগে ঘটেছে। সেগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা নয়, ছাত্র নামধারী কিছু অসৎ ব্যক্তি জড়িত ছিল। অর্থাৎ তারাও ঐখানে দেখতে আসতেন। কোন নিয়ম মানতেন না। নিয়ম না মেনে তাদেরকে আগে দেখতে হবে। এবং দেখতে গিয়ে যদি কখনও বচসা হতো, পিয়ন বা ডাক্তার যদি বলতেন নিয়ম মেনে আসেন, তাহলেই হাতাহাতি মারামারি হতো। একথা বলে কিন্তু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রকে দোষারোপ করছি না। গুটিকয়েক ছাত্রের জন্য এই কলঙ্কটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে পড়ছে। ঐ সময় সব সমস্যার সমাধান আমাদের প্রিয় ছাত্রনেতা বদিউজ্জামান সোহাগ একাই সামাল দিতেন। শুধু তাঁকে জানালেই হতো। মাননীয় প্রক্টর বলেছেন (পত্রিকাতে দেখেছি), তিনি ছাত্রদের শান্ত করার জন্য মামলা করেছেন। প্রক্টর যদি অভিভাবকই হন, তাঁর ¯েœহ এবং শিক্ষা, যদি ছাত্ররা গ্রহণ করে থাকে, তাহলে মামলা ছাড়াও শান্ত রাখতে পারতেন। কোর্ট বিল্ডিং এ জামিন নিতে গিয়ে ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ যেভাবে সিঁড়িতে বসেছিলেন, এটা দেখে প্রক্টর সাহেব লজ্জিত হয়েছেন কি? আমরা চিকিৎসক সমাজ কিন্তু লজ্জিত এবং অসহায় বোধ করছি। আজকে যদি ছাত্র সংসদ বা সত্যিকার ছাত্র নেতৃত্ব থাকত, তাহলে এটা ছাত্ররাই সামাল দিতে পারতেন, প্রক্টরের প্রয়োজন হতো না। সাম্প্রতিককালে ডাক্তারদের ওপর রুগীদের বা তার আত্মীয়স্বজনদের ক্ষোভের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে কোন জটিল রোগের চিকিৎসা কোন ডাক্তার দিতে সমর্থ হলেও, তা না দিয়ে নামী-দামী হসপিটালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ নিগৃহীত হওয়ার ভয়। এতে করে ক্ষতি শুধু রোগীদের হচ্ছে না, তেমনি চিকিৎসকও তার দক্ষতা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তার সম্মানটুকু তারা ধরে রাখতে পারছেন না। এ ভাবে চললে ভবিষ্যতে জটিল রোগীদের মৃত্যু হবে কোন হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে, নয় এ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে কোন মহাসড়কের ওপরে। আমরা জানি, কিছুদিন আগেই ভারতে এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটত। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসকের ওপরে বাংলাদেশের মতই আচরণ হতো, হাসপাতাল ভাঙচুর হতো। কয়েকদিন আগেই বিড়লার এএমআরআই হাসপাতালটি একইভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, শুধুমাত্র একটি রোগীকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টের একটি রায় ছিল যে, কোন ডাক্তারের উপরে রোগীর মৃত্যুর জন্য তার আত্মীয়স্বজনদের কোন অভিযোগ থাকলে, অভিযোগ দায়েরের পরে আইনের খাতায় যদি ডাক্তার দোষী সাব্যস্ত না হন, তাহলে তার ওপর অত্যাচার করলে অত্যাচারীর শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং সে শাস্তির মাত্রা বোধহয় ছিল পঞ্চাশ হাজার রুপী জরিমানা এবং তিন বছর পর্যন্ত কারাদ-। কিছুদিন পূর্বে মহারাষ্ট্রের ডাক্তাররা ৫ দিন ধর্মঘট করে রোগী এবং সরকারকে বাধ্য করেছিলেন আইন প্রণয়ন করার জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিল এখনও একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারা বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন এবং বিএমডিসির কাউন্সিল মেম্বার হন ঐ ক্ষমতাসীন দলের এমপি, চিকিৎসক, অন্যান্য পেশাজীবী আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ইত্যাদি। বিএমডিসি শুধু রেজিস্ট্রেশন নয়, কোর্স কারিকুলাম নয়, এমনকি ডাক্তারদের অন্যায়ের জন্য শাস্তি দেবার অধিকার রাখে। তাই যে কোন ধরনের ভুল চিকিৎসার জন্য ভুক্তভোগী রোগী বা তার স্বজনরা বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল-এ অভিযোগ করা যুক্তিসঙ্গত ও আইনসঙ্গত। বাংলাদেশে এমন নজির আছে যে, ভুল চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে আজীবনের জন্য। এটাও সত্যি ডাক্তারদেরও ভেবে দেখা উচিত, এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা অহরহ কেন হচ্ছে। কেনইবা জনগণের অপ্রাপ্তি বা অসন্তোষের কারণে এতটা দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটছে। এখানে চিকিৎসা দাতা এবং গ্রহীতাÑএই দু’য়ের মধ্যে মানসিক একটা পার্থক্য রয়েছে। তেমনি প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা অসম্ভব উঁচু ধরনের থাকছে। প্রাপ্তি যখন আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় একটু কম হয়ে যায়, তখন এই অশান্তির সৃষ্টি হয়। রোগীর আত্মীয়স্বজনদেরও জানতে হবে কোন অবস্থায় তারা রোগীটাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তারাই বা কেন রোগীটাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো অবস্থায় আনতে পারেন না। অনেক অসুখ আছে যেগুলো নিরাময়যোগ্য নয় এবং অনেক অসুখ আছে যেমন সেরিব্রো ভাসকুলার এ্যাকসিডেন্ট অর্থাৎ স্ট্রোক, অথবা ব্রেইন টিউমার। রোগীদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় এবং এসে ডাক্তারদের বলা হয় অপারেশন করেন, রোগী বাঁচুক আর মরুক সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু যেই রোগী মারা যায়, সেই ক্ষেত্রেই কিন্তু রোগীর আত্মীয়স্বজন কিংবা অভিভাবকরা অসম্ভবভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ দুটো। একটি হলো তারা নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছেন। তারা ভুলে যান তারাই বাধ্য করেছিলেন চিকিৎসককে অপারেশন করার জন্য। দ্বিতীয়টি হলো ভাঙচুর করলেই হয়ত হাসপাতালের বিল দেওয়া লাগবে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককেও ভাবতে হবে যে, আমি কোন অবস্থায় কার গায়ে ছুড়ি ধরব! চিকিৎসক দেবদূত নন। কিন্তু অনেক দিন ধরেই সমাজে এটা প্রচলিত ছিল, রোগীরা এসে ডাক্তারকে বলতেন ওপরে আল্লাহ নিচে আপনি। কখনও বলতে শুনিনি যে, ওপরে আল্লাহ মাঝে লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা আর নিচে আপনি। অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর পরেই ডাক্তারদের স্থান দিয়ে দেন। আমরাও কি সেই স্থানটিকে রক্ষা করতে পেরেছি? তবে কথায় কথায় যদি সিনিয়র ডাক্তারদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়, সেটা কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা দেখেছি উপজেলা লেবেলে, জেলা লেবেলে, এখন খোদ রাজধানীতেও এই অত্যাচার হচ্ছে। এই ঘটনাগুলোর পিছনে যে অন্তর্নিহিত রহস্য বা অন্য কোন ঘটনা থাকে, সেটা কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। যখনই যেই ঘটনা ঘটেছে ঘটনার পরে মীমাংসা হয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা, যে আইনের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক বা সন্ত্রাসী বা ভাঙচুরকারী বা রোগীর আত্মীয়স্বজনÑ যেই হোক না কেন, যিনি দোষী হবেন তিনি যথোপযুক্ত সাজা পাবেন। লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×