ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চুয়াডাঙ্গার জঙ্গী আস্তানায় অভিযান শেষ

ঝিনাইদহ অঞ্চলে নব্য জেএমবির সারোয়ার তামিম গ্রুপ সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৮ মে ২০১৭

ঝিনাইদহ অঞ্চলে নব্য জেএমবির সারোয়ার তামিম গ্রুপ সক্রিয়

এম রায়হান, ঝিনাইদহ থেকে ॥ ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চুয়াডাঙ্গা গ্রামে পাঁচটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান শেষ করেছে র‌্যাব। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে ঝিনাইদহ র‌্যাব ক্যাম্পে প্রেস ব্রিফিং করে এ অভিযান সমাপ্তির ঘোষণা দেয়া হয়। র‌্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান এ ঘোষণা দেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে র‌্যাবের এ অভিযান শুরু হয়। ঘটনাস্থল থেকে ২শ’ গজের মধ্যে ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা আসার পর জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট, একটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর পর পরই অভিযান শেষ করা হয়। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার নব্য জেএমবি সদস্য সেলিম (৩৭) ও প্রান্তর (১৭) দেয়া তথ্যমতে র‌্যাব গত দু’দিন ধরে এ অভিযান চালায়। গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় বাঁশবাগান, ঝোপঝাড়ের মধ্যে মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল বোমা, বিস্ফোরক, মাইন, সুইসাইডাল ভেস্ট, ডিনামাইট স্টিকসহ বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক সার্কিট; যা দেখে সহজে বোঝার কোন উপায় ছিল না। র‌্যাব আস্তানাগুলো চিহ্নিত করে এসব উদ্ধার করে। এ অভিযানের শুরু থেকে র‌্যাবের ঢাকা থেকে মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান, পরিচালক অপারেশন লে.কর্নেল মাহমুদ, র‌্যাব ৬ এর কমান্ডিং অফিসার এডিশনাল ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম, ঝিনাইদহ র‌্যাবের অধিনায়ক মেজর মনির আহমেদ, র‌্যাবের এএসপি আজাদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ, ডিজিএফআই, এনএসআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খুলনা থেকে র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা আসার পর জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট ও একটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর আগে বিস্ফোরক, ভেস্ট, মাইন, ডিনামাইট স্টিক উদ্ধারের স্থানগুলো সাংবাদিকদের ঘুরে ঘুরে দেখান র‌্যাবের মিডিয়া উইং মুফতি মাহমুদ খান। প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান বলেন, র‌্যাবের তথ্য ছিল, এ অঞ্চলে নব্য জেএমবির কিছু সদস্য আছে এবং তাদের কাছে বিপুল বিস্ফোরক আছে। অন্যান্য যেসব সরঞ্জাম আছে তা দিয়ে আইডি তৈরি করা যায় এবং কিছু ভেস্ট আছে, যা তারা পরবর্তিতে কোন নাশকতার কাজে ব্যবহার করতে পারে। এ তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব চুয়াডাঙ্গা গ্রামে সোমবার রাতে অভিযানে যায়। সেখানে ওহাব বিশ্বাসের বাড়ির পাশের বাঁশবাগানের ভেতর থেকে আফতাব উদ্দিনের ছেলে সেলিম (৩৫) ও মতিয়ার রহমানের ছেলে প্রান্তকে গ্রেফতার করে। তাদের দু’জনেরই বাড়ি চুয়াডাঙ্গা গ্রামে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক গত দু’দিন ধরে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানে দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট, একটি মাইন, হাই এক্সপ্লোসিভ, ১৮ নিউজেল, ১৮৬ বৈদ্যুতিক সার্কিট, পাঁচটি বোমা ও ৪ ড্রাম রাসায়নিক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে সুইসাইডল ভেস্ট, মাইন, বোমা নিস্ক্রিয় করা হয়েছে। বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট গ্রামের জঙ্গী আস্তানাগুলো তল্লাশি করে এলাকায় বসবাসকারী মানুষ ঝুঁকিমুক্ত বলে নিশ্চিত করেছে। বসবাসকারীদের ভয়ের কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, গ্রেফতার সেলিম ও প্রান্ত ২০১৪ সাল থেকে নিউ জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তারা বিস্ফোরক নাড়াচাড়া করার মতো সাহস ও পারদর্শী। লিমন নামের একজন তাদের সংগঠিত করছে। গত ৭ মে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর হাঠাতপাড়ার জঙ্গী আস্তানায় আব্দুল্লাহ ও তুহীন নিহত হয়। তারা নিহত হওয়ার আগে ২০ এপ্রিল প্রান্তর কাছে দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট দেয়। ভেস্ট দুটি কোন গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখতে বলে। বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তার কাছেই থাকবে। বজরাপুর জঙ্গী আস্তানায় নিহত তুহীনের আপন বড় ভাই সেলিম। প্রান্ত চাচাত ভাই। নিহত তুহীনের সঙ্গে সেলিম ও প্রান্ত বিস্ফোরক সংগ্রহ, বিস্ফোরক সরবরাহ, আইডি সরবরাহ করাসহ নাশকতার পরিকল্পনার মধ্যে এরা ছিল। জঙ্গীরা এ অঞ্চলকে কেন বেছে নিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘন জনবসতি, বিস্ফোরকের সহজলভ্যতা যেখানে আছে সে ধরনের এলাকায় তারা এ ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। তিনি বলেন লিমন নামে একজন এ অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করছে। লিমন এসব বিস্ফোরক কৌশলে সংগ্রহ ও সরবরাহ করার কাজ করে থাকে। তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আরেকটি স্থান আছে যেখানে তারা বিস্ফোরক রাখত এবং আইডি সেখানেই প্রস্তুত হতো। তিনি বলেন, এসব আস্তানা থেকে উদ্ধার এসব বিস্ফোরক, বোম, ভেস্ট, মাইন অন্য কোন স্থানে নাশকতার কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সে ব্যাপারে র‌্যাব কাজ করছে। তিনি বলেন এ অঞ্চলে নব্য জেএমবির সরোয়ার তামিম গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতার সেলিম ও প্রান্ত সরোয়ার তামিম গ্রুপের সদস্য। তাদের সঙ্গে যারা আছে বা যারা সহযোগিতা করছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান। এর আগে ঝিনাইদহ র‌্যাব ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর মনির আহমেদ জানান, সোমবার রাতে সেলিম ও প্রান্ত নামে দুই নিউ জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক চুয়াডাঙ্গা গ্রামে অভিযান চালানো হয়। প্রথম দিকে র‌্যাব দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধ্যান পেলেও অভিযান চলাকালে পর্যায়ক্রমে তিনটি জঙ্গী আস্তানাসহ মোট পাঁচটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধ্যান পায়। এসব জঙ্গীর সঙ্গে যারা আছে এবং সহযোগীদের দ্রুতই গ্রেফতার করে হবে। তিনি বলেন, দেশে এই প্রথম জঙ্গী আস্তায় ডিনামাইট স্টিক ও মাইন উদ্ধার হলো। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি ইউনিয়নের চুয়াডাঙ্গা গ্রাম। এ গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় ঘাঁটি গাড়ে নব্য জেএমবি। চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আফতাব উদ্দিনের ছেলে সেলিম (৩৫) ও মতিয়ার রহমানের ছেলে প্রান্তকে (১৭) গ্রেফতার করে র‌্যাব। গত ৭ মে সেলিমের ভাই তুহীন মহেশপুর উপজেলার বজরাপুর গ্রামের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানের সময় নিহত হয়। প্রান্তও তুহীনের চাচাত ভাই। এ ছাড়া বজরাপুর জঙ্গী আস্তানায় নিহত আব্দুল্লাহর বাড়িও পোড়াহাটি। তার বাড়িতে গত ২১ ও ২২ এপ্রিল পুলিশ অভিযান চালায়। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, বিস্ফোরক, ভেস্ট, বম, নাইনএমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়। সে পালিয়ে গেলেও ৭ মে বজরাপুর জঙ্গী আস্তানায় নিহত হয়। এলাকাবাসী জানায়, র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার সেলিম আগে ঝিনাইদহ বিসিক শিল্প নগরীতে একটি কোম্পানিতে চাকরি করত। দু’বছর আগে সে চাকরি ছেড়ে দেয়। চাকরি ছাড়ার পরে তার চলাফেরা ছিল সন্দেহজনক। এলাকার লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা মেলামেশা করত না। তার দুই ভাই বিদেশে থাকে। ছোট দুই ভাই বাড়িতে থাকে, আরেক ভাই তুহীন মহেশপুরর জঙ্গী আস্তানায় নিহত হয়েছে। প্রান্ত কলেজে লেখাপড়া করত। গ্রামবাসী মিন্টু মিয়া, সরোয়ার হোসেন, হাবিবুর রহমান, মমতাজসহ কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেলিম ও প্রান্ত গ্রামে খুবই স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করত। কেউই ধারণা করতে পারেনি তারা জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গ্রামের জঙ্গী আস্তানাগুলো থেকে এসব বিস্ফোরক উদ্ধার ও জঙ্গীদের গ্রেফতারে তারা খুশি।
×