ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিবর্তনে বাই সাইকেল ॥ বৈচিত্র্য ও কদর বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ মে ২০১৭

বিবর্তনে বাই সাইকেল ॥ বৈচিত্র্য ও কদর বাড়ছে

সমুদ্র হক ॥ বাইসাইকেল। নিকট অতীতে নাম ছিল বাইক। মানবশক্তিতে পায়ে চালিত পরিবেশবান্ধব দ্বিচক্রযান। যানবাহনের যান্ত্রিক যন্ত্রণায় বাইসাইকেল প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবং বিবর্তনের পালায় ফিরে আসছে কারিগরি শৈলীতে আধুনিকায়ন হয়ে। ব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মেদ-ভুঁড়ি, ওজন কমানো, কখনও রোগ নিরাময়ে সহযোগী বাইসাইকেলের কদর দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে দূষণের জ্বালা নিয়ন্ত্রণে বাইসাইকেল বড় ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে দেশে কয়েকটি সংগঠন নগর-মহানগরের সড়কে নির্বিঘেœ বাইসাইকেল চলাচলের আলাদা পথ দাবি করেছে। শহর ও গ্রামের অনেকে বাইসাইকেলে চলাচল বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েরাও আজকাল সাইকেল চালাচ্ছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মা-বাবা শিশুসন্তানদের ছেলেবেলাতেই বাইসাইকেল চালনায় অভ্যস্ত করে তুলছে। শিশুদের জন্য বেবি বাইসাইকেল তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের কথা: উন্নতমানের বাইসাইকেল এখন দেশেই তৈরি হয়ে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপানসহ বিশ্বের অন্তত ৩০ দেশে রফতানি হচ্ছে। উন্নতবিশ্বে পরিবেশ দূষণ কমাতে এবং শরীর ঠিক রাখতে বাইসাইকেলের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অফিসের অনেক কর্মকর্তা নারী ও পুরুষ গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে সাইকেলে চলাচল করছেন। সুইডেনে কয়েক নারীমন্ত্রী সাইকেলে চলাফেরা করেন। সাইকেলের আবিষ্কার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। নিকট অতীতে বাইসাইকেল ছিল সড়ক যোগাযোগের জনপ্রিয় বাহন। বর্তমানের প্রবীণ ও মধ্যবয়সীরা বাইসাইকেল চালিয়েছেন। সাইকেল আজও তাদের কাছে স্মৃতিময় অধ্যায়। ষাটের দশকে পুলিশ দায়িত্ব পালনে বাইসাইকেল ব্যবহার করত। গ্রামের মেঠোপথ, শহরের পাকা সড়কে চলত সাইকেল। ষাটের দশকের শুরুতে জাপানের তৈরি হোন্ডা-৫০ মোটরসাইকেল (মোটরবাইক) আমদানি হয়ে এলে গ্রামের গেরস্ত ও শহরের মধ্যবিত্তরা জাপানের হোন্ডা ব্রান্ডের মোটর সাইকেল কেনেন। বাইসাইকেলের কদর থাকার পরও মোটরসাইকেল রাস্তার রাজা হতে থাকে। সেদিনের বাইসাইকেলগুলোর নাম ছিল বিএসএ, রেলি, হিরো ইত্যাদি। রেলি সাইকেল তো মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বিয়ের সময় নতুন জামাইয়ের উপহার চাহিদা ছিল রেলি বাইসাইকেল, ট্রানজিস্টর (রেডিও)। গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিতে সাইকেলের কথা সুন্দর করে বলা হয়েছে। উপহার আবদার সাইকেলের জায়গা দখল করে হোন্ডা। একটা সময় সাইকেলের উচ্চতা ছিল বেশি। হ্যান্ডেল বা স্টিয়ারিংয়ের হাতলের নিচে ব্রেক, বেল। চিকন টায়ারের ভেতরে টিউব। এই টায়ারে বোতলের আকৃতির ডায়নামা এঁটে সামনে বাতি জ্বালানো হতো। পেছনে কেরিয়ার। চাকা ঘোরাবার জন্য প্যাডেলের সঙ্গে চেন। ছোট্ট একটু বসার জায়গা। বেশি ব্যাসার্ধের দুটি চাকার সঙ্গে স্পোক। একজনের চলার জন্য নির্মিত বাইসাইকেলে চালকের আসনের সামনের লম্বা রডের ওপর আরেকজন বসত। কখনও পেছনে জিনিসপত্র রাখার কেরিয়ারেও একজন বসে এক সাইকেলে তিনজন চলত। চালকের শক্তি ব্যয় হতো বেশি। কলেজে দূরের শিক্ষার্থীরা সাইকেলে চেপে আসত। বাইসাইকেলে দুজন উঠলে ডবল রাইডিংয়ের অপরাধ হতো। সে-ই সাইকেলের বিবর্তনে বর্তমানের সাইকেল এতটাই আধুনিক হয়েছে যা দেখে অবাক হতে হয়। পুরাতন আমলের সাইকেলও দোকানে আছে। এর পরিচিতি এখন ক্লাসিক সাইকেল। বগুড়ার সাইকেলের শোরুম, সাইকেল শোরুমে কারিগরি শৈলীতে আধুনিকায়ন হওয়ার পর অনেক সাইকেল এসেছে। আধুনিক নামকরণ হয়েছে ‘ডিজিটাল’। তবে বলা হয় মাউন্টেন বাইক বা সাইকেল। এই সাইকেলে পাহাড়ে ওঠা যায়। সাইকেলের চেনের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় গিয়ার বসানো হয়েছে। ১০ থেকে ১১টি গিয়ারে প্যাডেল চালালে গতি কম-বেশি করা যায়। যেমন প্যাডেল কম করতে হয় গতি বেড়ে যায়। সাইকেলের আসন উপর-নিচ (আপডাউন) করা যায়। সাইকেলের সঙ্গে আছে মোটরগাড়ির ঝাঁকুনি কমানোর মতো শক এ্যাবজর্বার। ব্রেকও আধুনিকায়ন হয়ে হাইড্রলিক হয়েছে। স্টিল বডি, মিক্সড বডি ও এ্যালুমিনিয়াম বডির সাইকেল মেলে। হালকা সাইকেল কয়েক ভাঁজ করে (ফোল্ডিং) ব্যাকপ্যাকে ভরে বহন করা যায়। হালে ফোল্ডিং সাইকেলের কদর বেড়েছে। বর্তমানের বাইসাইকেলের টায়ারও আগের চেয়ে আলাদা। অপেক্ষাকৃত মোটা এই টায়ার টেকসই বেশি। গিয়ারে দ্রুত চলার উপযোগী করে এই টায়ার বানানো হয়েছে। বড়, মাঝারি, ছোট ১২, ১৪, ১৮, ২০, ২৪ ও ২৬ ইঞ্চি মাপের সাইকেল মেলে। দাম চার হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। টঙ্গী, জয়দেবপুর, চট্টগ্রাম ও হবিগঞ্জে উন্নতমানের সাইকেল তৈরি হচ্ছে। এখন আর বাইসাইকেল আমদানি করতে হয় না। তবে চীন থেকে এখনও সাইকেল আসে। চীনের তৈরি সাইকেলের চেয়ে বাংলাদেশের তৈরি বাইসাইকেল অনেক উন্নতমানের। অনেক তরুণী শিক্ষার্থী এখন সাইকেল চালিয়ে পথ চলে। কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার নারী কর্মীরা সাইকেল চালিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে। শহরের কাছাকাছি এলাকার কর্মজীবীরা এখন বাইসাইকেলে চেপে কর্মস্থলে আসে। পরিবেশবান্ধব বাইসাইকেল দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
×